নির্বাচনের সময়ের উপযুক্ততায় জামায়াতের হঠাৎ মনোযোগ পরিবর্তন!
গত বছরের জুলাই-আগস্টে বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর থেকে বিএনপি ‘অবিলম্বে সংসদ নির্বাচন’ করার দাবি নিয়ে বেশ জেদী অবস্থানে ছিল। তখন বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান এবং অন্যান্য নেতা নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য ‘যৌক্তিক সময়’ দিতে বলা হয়েছিল।
সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডন থেকে দেশে ফিরে জাতির উদ্দেশে ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন, যা জামায়াতের পক্ষ থেকে স্বাগত জানিয়েছে। অর্থাৎ, নির্বাচনের যে সময় নির্ধারণ করা হবে, জামায়াত সেটিকেই ‘যৌক্তিক সময়’ হিসেবে মেনে নেবে। জামায়াত ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জেলায় সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা তৈরি এবং কিছু প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে।
কিন্তু ৪ জুলাই রংপুর জিলা স্কুল মাঠে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া কঠিন।’ এ বক্তব্যে প্রশ্ন উঠেছে, জামায়াত কি নির্বাচন থেকে সরে যাচ্ছে? যদিও একই সমাবেশে ৩৩ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করায় তারা নির্বাচন থেকে সরে না যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।
জামায়াত আমিরের এই নতুন অবস্থান রাজনৈতিক মহলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘ মেয়াদী আওয়ামী সরকারের দুঃশাসনের পর দেশের মানুষ মুক্তির আশায় ছিল এবং শান্তি-সমৃদ্ধির প্রত্যাশা করেছিল, কিন্তু বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। বাংলাদেশের ইতিহাস বলছে, মানুষের স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝে বড় ফারাক রয়েছে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পরও জনগণের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারও দেশকে উন্নত করতে সময় নিয়েছিল এবং ১৯৭২ সালে তিনি স্বীকার করেছিলেন যে আগামী তিন বছরে তারা বড় পরিবর্তন আনতে পারবে না।
যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন থেকে জামায়াতের হঠাৎ পরিবর্তন! শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ বাড়ার কারণে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছিল। এত উচ্চ জনপ্রিয় নেতা দেশ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করায় অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। এরপরও তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। ক্ষমতা একক দখল করতে তিনি ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তবে দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের মুক্তির স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থতা ও হতাশা সরকারের নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণ ছিল। ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনের পরও নতুন দেশের বাস্তবতা সহজ ছিল না এবং শেখ মুজিবুর রহমান তিন বছর সময় চেয়ে ব্যর্থতার দায়ভার নিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর তিন বছরেও কিছু করার সামর্থ্য না থাকলে, অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলো কেবল নির্বাচন দাবি নিয়ে চাপ দেয়া কেন? সরকার কিছু সংস্কারের প্রস্তাব দিলেও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তা মানতে নারাজ।
সরকার বা বিরোধী দল যেটাই বলুক, বিএনপির পছন্দ না হলে সবকিছু অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য হয়। এর ফলে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত। প্রশ্ন থেকে যায়, কি আমরা আরেকটি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছি?
বিপ্লবের পরে প্রায় সব দল নিজেদের সফলতা দাবি করেছে, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াত। তবে ক্ষমতায় তাড়াহুড়ো করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অসুবিধায় ফেলা দেশকে অস্থিতিশীল অবস্থায় ফেলার চেষ্টা বলে মনে হয়।
বিশ্বের বিপ্লবগুলোতে অরাজকতা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে তা বেশি হয়নি। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক সময় রাজনৈতিক শোষণের হাতিয়ার হয়েছে। গত বছরও আন্দোলন দমনকালে বর্বরতা ঘটেছে, তবুও বিপ্লব সফল হয়েছে বলে তা বড় মাত্রায় হয়নি।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর কিছু মাস রাজনৈতিক দলগুলো দায়িত্বশীল ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শান্তি ফিরিয়ে আনতে ধৈর্যশীল ছিল এবং প্রশংসার দাবিদার। নতুন সরকারের কাজ সামলাতে কিছু সময় লাগে, কারণ অন্তর্বর্তী সরকার রাজনীতিবিদ বা নির্বাচিত প্রতিনিধি নয়, তারা সাময়িক দায়িত্বে নিয়োজিত।
যদিও রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা জানে, তবুও বিএনপি ‘অবিলম্বে নির্বাচন’ দাবি করে সরকারকে চাপে রাখছে এবং এখনো করছে। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের ক্ষমতা হারানোর পর বিএনপির অঙ্গসংগঠনগুলো নানা অবৈধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে, যার ফলে দেশে সংঘর্ষ ও অপরাধ বেড়েছে, কিন্তু প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
বিএনপির প্রভাব বাড়ার আশঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হতে সাহস পাচ্ছে না, কারণ তাদের ওপর রাজনৈতিক চাপ রয়েছে। তাই অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
ফলে আইনশৃঙ্খলার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। নির্বাচনের সময় যত কাছাকাছি আসবে, পরিস্থিতি তত খারাপ হবে। জামায়াত আমিরের আশঙ্কা যে এ পরিবেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা অমূলক নয়। তিনি বলছেন, তার দল ‘প্রশাসনিক ক্যু’ বরদাস্ত করবে না এবং ভোট কেন্দ্রে দুর্নীতি চলতে দেবে না। তবে তিনি মনে করেন একটি দল ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদের স্বপ্ন দেখছে’ এবং তার দল তা ভেঙে দেবে।
জামায়াতও কি ক্ষমতায় আসার আশা পোষণ করে? যদিও তা সম্ভব নয়, তারা অন্তত নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করবে। তারা সম্ভাবনাময় আসনে প্রার্থী দেবে এবং ১৯৯৬ সালের মতো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। বিএনপির আচরণে জামায়াত ভয় পেয়ে থাকতে পারে যে নির্বাচন একতরফা হবে এবং প্রশাসন ফলাফল বিকৃত করবে।
যদি এমন ভয় থাকে, তাহলে সব দলের উচিত প্রস্তুতি নেয়া। কারণ যেকোনো পরিস্থিতিতেই নির্বাচিত সময়েই নির্বাচন হওয়া জরুরি। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক অবস্থা অস্থির থাকবে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta