পিআর : দেশের প্রস্তুতি কতটা
যদি কেউ প্রশ্ন করেন, কোন পদ্ধতি ভালো: পিআর না প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থা? প্রথম দর্শনে প্রচলিত ব্যবস্থার থেকে পিআর অনেক বেশি কার্যকর মনে হয়। পিআরের প্রধান সুবিধা হলো সংসদে প্রায় সব দলের প্রতিনিধি থাকার সুযোগ থাকে, যা একটি ভারসাম্যপূর্ণ সংসদ গঠন নিশ্চিত করে। এতে একক দলের আধিপত্যের কারণে স্বৈরাচারী শাসনের সম্ভাবনা কমে। এছাড়া পিআরে ভোট একদম নষ্ট হয় না। যেখানে প্রচলিত ব্যবস্থায় শুধুমাত্র বিজয়ীর ভোট গণ্য হয়, হারানো দলের ভোটের কোন মূল্য থাকে না।
অন্যদিকে, প্রোপরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোটের মূল্যায়ন হয়। ১ শতাংশ ভোটও পাওয়ার মাধ্যমে একটি দল সংসদে সদস্য পায়। অর্থাৎ কোনো দল ভোটে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় না। পিআর ব্যবস্থায় পরাজয়ের কোনো ধারণাই নেই।
তবে পিআরেরও কিছু জটিলতা রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পিআরের আলাদা আলাদা ধরণ প্রচলিত আছে — ক্লোজড লিস্ট, ওপেন লিস্ট, মিক্সড সিস্টেম ইত্যাদি। ক্লোজড লিস্টে ভোটাররা প্রার্থী চেনেন না, কারণ প্রার্থী তালিকা দল নির্ধারণ করে রাখে। ওপেন লিস্টে প্রার্থী তালিকা আগে জানা যায়, ভোটের পর দল তালিকার ক্রম অনুযায়ী সদস্য নির্বাচন করে। মিক্সড পদ্ধতিতে কেউ সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন, কেউ পিআর কোটায় আসন পান, যা সবচেয়ে জটিল।
আরেক সমস্যা হলো, একই নির্বাচনী এলাকায় একাধিক এমপি নির্বাচিত হওয়া, কখনো নিজের এলাকা ছাড়াও অন্য এলাকা থেকে এমপি আসা। এতে এলাকার মানুষের নিজস্ব প্রতিনিধি না থাকায় এলাকার সমস্যা সঠিকভাবে তুলে ধরতে অসুবিধা হয়। তবে সংসদের প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন, আর স্থানীয় প্রশাসনের কাজ নয়। সাধারণত, অতিথি এমপির মাধ্যমে এলাকার সমস্যা সমাধান করানো যায়।
বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে মিক্সড বা পিউর পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হয় এবং তারা সফল। তাই বাংলাদেশেও প্রয়োজনে নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কতটুকু বদলেছে, সেটি ভাবতে হবে। এমপিদের আইনগত কর্তৃত্ব সীমিত হলেও বাস্তবে তারা স্থানীয় প্রশাসন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রভাবশালী। এমপিরা প্রায় স্থানীয় প্রশাসকের ভূমিকা পালন করেন।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র অনেক দুর্বল। অনেক ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে পদ পাওয়া যায়। দলের তহবিল কোথা থেকে আসে সঠিক তথ্য নেই। বড় বড় ইফতার মাহফিলে প্রচুর টাকা খরচ হয়, কিন্তু এর উৎস জানা যায় না। আমরা সংস্কারের কথা বলি, কিন্তু দলের ভিতরের সংস্কৃতি বদলানোর প্রতি তেমন গুরুত্ব দিই না। তাই পিআর পদ্ধতি কতটা সফল হবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন।
পিআর ব্যবস্থায় কখনো একই এলাকায় দুইজন এমপি নির্বাচিত হতে পারে, যা সমস্যা সৃষ্টি করবে। ইলেকশন শেষে কোটায় এমপি হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হবে, যার ফলে অনেকেই বাদ পড়তে পারে, যদিও প্রচলিত পদ্ধতিতে ভোটার সঠিকভাবে যোগ্য প্রার্থী বেছে নেন। তবে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং পিআর সিস্টেমেও হতে পারে, যা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। এইসব অনিয়ম ও অগণতান্ত্রিকতা মোকাবেলায় ইলেকশন কমিশন, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
এছাড়া বর্তমান সংবিধানের আওতায় পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করা সম্ভব নয়, কারণ সংবিধানে একক আসন ভিত্তিক নির্বাচন উল্লেখ রয়েছে। তাই পিআরের জন্য সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। বর্তমানে জাতীয় সংসদ না থাকায় সেটি কঠিন। নতুন সংবিধানের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন দাবির পরিবেশ তৈরি হতে পারে, যা দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াবে।
অতএব, এখনই পিআর পদ্ধতিতে যাওয়ার আগে সুপরিকল্পিত ধাপে ধাপে সংস্কারের প্রয়োজন। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় পিআর একটি উন্নত বিকল্প হতে পারে, কিন্তু এর আগে সব দিক ভালোভাবে বিবেচনা করা জরুরি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে অথবা রাজনৈতিক মতানৈক্য তীব্র হতে পারে। তাই দ্রুত সময়ে নির্বাচিত সরকার গঠন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতীয় সরকার গঠন হলে দেশ আরও স্থিতিশীল হবে। বর্তমানে নির্বাচিত সরকার না থাকায় বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, যা অস্বস্তিকর। ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠিত হলে আইনের শাসন নিশ্চিত করা সহজ হবে।
আইনের শাসন ও গণতন্ত্র শক্তিশালী হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, যদি সংশ্লিষ্টরা ইচ্ছুক হন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta