সেনাবাহিনীকে বিতর্কের বাইরে রাখতে হবে
দেশে এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) শীর্ষ নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে এনসিপির শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ হাসনাতের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত জানিয়েছেন। শুধু হাসনাত নন, আরও অনেকে সেনাবাহিনী নিয়ে অনভিপ্রেত মন্তব্য করছেন।
আমরা জানি, সেনাবাহিনী দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা মানে দেশের সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলা। জাতীয় সংকটে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সেনাবাহিনীর আলোচনা হতে পারে, যার মূল উদ্দেশ্য সংকট নিরসনের পথ খুঁজে বের করা।
সংকটময় সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সেনাবাহিনীর আলাপ হতে পারে, মতপার্থক্য থাকতে পারে। তবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় তৈরি হলে সেটি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করাই গণতন্ত্রের নিয়ম। জনগণ স্থিতিশীল পরিবেশ চায়, অস্থিরতা কাম্য নয়।
অনেকেই না বুঝে সেনাবাহিনী নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, রাজনীতি রাজনীতিবিদদের বিষয়, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। যদি তা মেনে নিই, তবে প্রশ্ন উঠবে, কেন ৫ আগস্ট সব রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতা সেনাবাহিনীর দিকে তাকিয়ে ছিল? ছাত্র প্রতিনিধি ও আন্দোলনকারীরা সেনা সদরে দীর্ঘ বৈঠক করেছিলেন। এমনকি সেনাপ্রধানের মধ্যস্থতায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল।
আমরা চাই দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকুক। অতীত টেনে এনে বিতর্ক তৈরি করলে অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে। অনুমানের ভিত্তিতে কাউকে অভিযুক্ত করা হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে সেনাবাহিনীকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা জরুরি। দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় সেনাবাহিনীকে নিরপেক্ষ রাখা সবার দায়িত্ব।
সেনাবাহিনীর প্রতি বিরূপ মন্তব্য না করার আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান ২৫ ফেব্রুয়ারি বলেছিলেন, ‘সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে কিছু মানুষ বিদ্বেষ পোষণ করছেন, কিন্তু কেন তা স্পষ্ট নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একমাত্র বাহিনী, যারা জনগণের জন্য কাজ করছি। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীও আমাদের সঙ্গে রয়েছে।’
সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার আত্মীয়—এই পরিচয়ে জেনারেল ওয়াকারকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন—এটি সহজেই বোঝা যায়। সেনাবাহিনীর ১৩ লং কোর্সে তাঁর কোর্সমেট মেজর জাবের (অব.) এক জাতীয় দৈনিককে বলেছিলেন, ‘জেনারেল ওয়াকার ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর আদেশ মানতে পারেননি। ১৭ জুলাইয়ের পর থেকে তিনি এ নিয়ে চাপের মুখে ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন।’
অভ্যুত্থানের পর শিল্প-কারখানাগুলোর নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠেন। ৮ আগস্ট ঢাকায় সেনা সদরে বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং শিল্প-কারখানার নিরাপত্তার বিষয়ে সহযোগিতা চান। সেনাপ্রধান তাদের আশ্বস্ত করেন যে তিনি রাষ্ট্রের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন। অভ্যুত্থানের পর আকস্মিক বন্যা মোকাবেলা, পুলিশ সদস্যদের মনোবল পুনরুদ্ধার, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং মাদকবিরোধী অভিযানে সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টা ছিল নিরলস।
১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে সেনা সদর মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক কার্যক্রম তুলে ধরেন। তিনি জানান, গত ৫০ দিনে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ৮৮টি অস্থির পরিস্থিতি ও ৩০টি প্রধান সড়ক অবরোধ নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া ৪২টি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে, যার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস ও রাজনৈতিক কোন্দলও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় রাজনৈতিক নেতাদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত। সেনাপ্রধান কিংবা সেনাবাহিনীর সদস্যদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। দেশে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র সক্রিয় রয়েছে, যা মোকাবেলায় সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। জনগণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তুষ্ট। এই অসন্তোষ দূর করতে না পারলে দেশ ভয়াবহ সংকটে পড়তে পারে। সেনাবাহিনীকে জনতার মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা এমন পরিস্থিতি চাই না, যা সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে। সেনাবাহিনীর দুর্বলতা সামনে আনা উচিত নয়। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয় এমন কর্মকাণ্ড থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta