তুম এখানে হাম এখান
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর প্রকৃত বিপদ ঘটেছিল। ওই যুদ্ধ কোনো গৌরব আনেনি। এই পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব ছয় দফা প্রস্তাব দিলেন। সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা ‘ষড়যন্ত্র’ করার কথা সামনে আসে।
ষড়যন্ত্রের সঙ্গে শেখ মুজিবের নাম জড়ানো হয়। সেনাকর্তারা পরিকল্পনা করেছিলেন যে ঢাকায় প্রকাশ্যে বিচার করে মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণের ধিক্কার আকর্ষণ করবেন এবং নির্বিঘ্নে তাকে ফাঁসি দিতে পারবেন। তবে ফলাফল ছিল বিপরীত। শেখ মুজিব পাকিস্তানি রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখান এবং বাঙালিদের পক্ষে দাঁড়ানোর কারণে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে এমন ধারণা থেকে বাঙালি জনগণের সমর্থন লাভ করেন এবং তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
এই পরিস্থিতিতে চতুর এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা হওয়ার জন্য রুটি, কাপড় এবং আবাসনের ‘সমাজতান্ত্রিক’ দাবি তুলে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে শুরু করেন।
জনবিক্ষোভের মুখে ইয়াহিয়া খানের জন্য সংখ্যাসাম্য ও এক ইউনিটের বিষয় দুটি বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। জনগণের চাপ মোকাবিলা করতে নির্বাচন ঘোষণা করতে হয়। নির্বাচন শেষে পূর্ব পাকিস্তানকে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬২টি আসন, আর পশ্চিম পাকিস্তানকে ১৩৮টি আসন দেওয়া হয়।
এক ইউনিট ভেঙে দেওয়ার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের অস্বীকার করা সুযোগ পায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফল ছিল সেনাশাসকদের জন্য আতঙ্কজনক এবং পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের জন্য বিপর্যয়কর। দেখা যায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের সব আসন জিতে নিলেও পশ্চিম পাকিস্তানে তারা একটিও আসন পায়নি। পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর দল ১৩২ আসনের মধ্যে ৮১টি আসন লাভ করেছিল।
এ পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।
পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের জন্য যেটা সম্ভব, সেনাশাসকদের জন্য তা ছিল অশনিসংকেত। একাত্তরের যুদ্ধের পর কিছু সেনাশাসক যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে লিখেছিলেন, যেখানে নানা কারণে বিপদ দেখানো হয়েছিল। তাদের মধ্যে একটি কারণ ছিল যে, শেখ মুজিব যদি প্রধানমন্ত্রী হন তবে তিনি সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে দেবেন এবং বাঙালিদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিতে চাইবেন।
এ পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা দেন যে সেনাবাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে, তবে সেই ব্যবস্থা থেকে কোনো শান্তি আসেনি। বাঙালি সেনারা পাঞ্জাবি সেনাকর্মকর্তাদের শাসনে থাকতে রাজি হয়নি।
পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তাদের জন্য এই পরিস্থিতি ছিল এক দুঃস্বপ্ন। যদি বাঙালিরা সেনাবাহিনীতে প্রতিনিধিত্ব চান, তবে সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ, মোহাজেরদের পক্ষ থেকে ন্যায়বিচারের দাবি উঠবে।
তবে একটি বিশেষ উদ্বেগ ছিল, যেমন—কর্নেল ওসমানী যদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন, পরিস্থিতি কী হবে? তিনি যারা তাঁর ওপর অত্যাচার করেছে, তাদের সহজে ছাড়বেন না। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা সব বাঙালিদের হাতে চলে যাবে।
নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া খান জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় এসেছিলেন এবং বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং তিনি (ইয়াহিয়া) থাকবেন না।
পরবর্তীতে ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে শেখ মুজিবকে শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন। নির্বাচনের পর ভুট্টো নানা উল্টাপাল্টা আওয়াজ তুলেছিলেন, এবং বলেছিলেন, পাকিস্তানে তিনটি রাজনৈতিক দল রয়েছে: আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি এবং সেনাবাহিনী।
ভুট্টো সেনাবাহিনীর প্রশ্রয়ে কিছু রাষ্ট্রদ্রোহী কথাবার্তা বলেছিলেন, এমনকি সেনাকর্তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে আওয়ামী লীগ একটি বুর্জোয়া দল, এবং তাদের পক্ষে কোনো জনবিদ্রোহ সম্ভব নয়।
যুদ্ধ চলাকালে ভুট্টো একটি বই লিখেছিলেন, ‘দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি’, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে তিনি আশা করেন সেনাবাহিনী শহুরে আওয়ামী লীগ সদস্যদের নিরস্ত্র করবে, কিন্তু গ্রামের মানুষকে গুলি করবে না। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি, কারণ পুরো বাংলাদেশ এক হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
ঢাকায় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে প্রহসনের সংলাপ চলছিল, তখন মুজিব এবং ভুট্টো একবার প্রেসিডেন্ট ভবনে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মুজিব ভুট্টোকে বলেছিলেন, ‘এরা আগে আমাকে মেরে ফেলবে, তারপর তোমাকে।’ ভুট্টো নাটকীয়ভাবে বলেছিলেন, ‘আমি সেনাবাহিনীর হাতে মরব, তবে ইতিহাসের হাতে মরব না।’ কিন্তু সেনাবাহিনী মুজিবকে বন্দি করতে সক্ষম হলেও, পাকিস্তান তখনো টিকে থাকতে পারেনি।
যুদ্ধের পর ভুট্টো সেনাবাহিনীর হাতেই প্রাণ হারান, আর সেনাবাহিনী মুজিবকে বন্দি করলেও পাকিস্তান ভেঙে গিয়েছিল।
ইয়াহিয়া তখন সর্বশক্তিমান হলেও, তার চারপাশে বাজপাখিরা বসে ছিল, এবং কোনো পদক্ষেপ তাঁর সম্মতি ছাড়া নেওয়া সম্ভব ছিল না। ভুট্টো ক্ষমতার লোভে সেনাশাসকদের সঙ্গে আঁতাত করেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, ‘তুম উধার হাম ইধার’।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta