আর্থিক, সামাজিক ও নৈতিক উন্নয়নে যাকাত
ইসলামের মূল স্তম্ভগুলির মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো জাকাত। এটি ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজের চালিকা শক্তির অন্যতম উপাদান। কোরআনে জাকাতের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে ৮২ বার, যা তার গুরুত্ব প্রকাশ করে।
‘জাকাত’ শব্দটি ৩০ বার, ‘ইনফাক’ শব্দটি ৪৩ বার এবং ‘সাদাকাত’ শব্দটি ৯ বার কোরআনে উল্লেখিত হয়েছে। কোরআনের মোট ১৯টি সুরায় জাকাতের আলোচনা পাওয়া যায়। ইসলামে সালাত মানুষের আত্মিক পবিত্রতার জন্য আর জাকাত সম্পদকে পবিত্র ও শুদ্ধ করার জন্য নির্দেশিত।
জাকাত বলতে অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ দান করা বুঝায়। এর শরিয়ত অনুযায়ী, সাহেব নিসাবের সম্পদ, জমির ফলন এবং খনিজ সম্পদের উপর একটি নির্দিষ্ট অংশ দান করা হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, ঈমানের প্রমাণস্বরূপ, এবং সম্পদের বৃদ্ধির জন্য এই দান করা হয়। জাকাত আদায় করে সমাজে অকল্যাণ দূর হয় এবং সমাজের দরিদ্রদের সহায়তা প্রদান করা হয়। ইসলামী রাষ্ট্রে এসব অর্থ নির্দিষ্ট খাতে বিতরণ করা হয়। শরিয়তে জমির ফসলের জাকাতকে ‘ওশর’ বলা হয়, যা হল ফসলের দশ ভাগের একভাগ।
জাকাত কোনো করুণার দান নয়, বরং এটি একটি নির্ধারিত অধিকার যা ধনীদের সম্পদের অংশ দরিদ্রদের জন্য। এটি ইসলামী সমাজ ও অর্থব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জাকাত দরিদ্র ও অসহায় জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধন করে।
জাকাত শুধু মহানবী (সা.)-এর সময়ই ফরজ ছিল না, এটি মানব সমাজের প্রথম দিন থেকেই পালন করা হয়েছে। তবে প্রতিটি সমাজে এর প্রয়োগের পদ্ধতি ছিল আলাদা। জাকাত ছাড়া সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ ও অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
আল্লাহ তাআলা নবী ইবরাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুব (আ)-এর ওপর জাকাতের বিধান দিয়ে বলেছেন, ‘আমি তাদের ইমাম করেছি, তারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথ প্রদর্শন করত।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৭৩)
বনি ইসরাঈলদের বিষয়েও আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গেই রয়েছি, যদি তোমরা সালাত কায়েম করো, জাকাত দাও।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১২)
এছাড়া ঈসা (আ.)-এর প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘সে বলল, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যত দিন জীবিত থাকি তত দিন সালাত ও জাকাত আদায় করতে।’ (সুরা : মারইয়াম, আয়াত : ৩১)
কোরআন ও হাদিসের আলোকে জাকাত
আল্লাহ কোরআনে বহু স্থানে জাকাত সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছেন।
সুরা বাকারার ১১০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং জাকাত প্রদান করো।’
সুরা বাকারার ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত আদায় করো আর বিনয়ীদের সঙ্গে বিনয় প্রকাশ করো।’
সুরা বাইয়্যিনার ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এবং তোমাদের এই আদেশ দেওয়া হয়েছে যে তারা বিশুদ্ধচিত্তে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, নামাজ কায়েম করবে, জাকাত দেবে আর এটাই সঠিক দ্বিন।’
সুরা তাওবার ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তবে তারা যদি তাওবা করে, নামাজ কায়েম করে ও জাকাত দেয়, তবে তারা তোমাদের দ্বিনি ভাই।’
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি আদিষ্ট হয়েছি এ জন্য যে আমি যুদ্ধ করব লোকদের সঙ্গে যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেবে যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল এবং নামাজ কায়েম করবে ও জাকাত দেবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৫)
জাকাত না দেওয়ার পরিণতি সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে জাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথাবিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় মালা পরিয়ে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪০৩)
জাকাতের আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব
জাকাত একটি বাধ্যতামূলক দান যা গরিবের অধিকার হিসেবে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। এটি ইসলামী অর্থব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জাকাত গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হলে এটি সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনে। সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য দূর হয় এবং বেকারত্ব কমে যায়।
ক্ষুধা বা দারিদ্র্য মানুষের অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। অভাবী মানুষ অপরাধে লিপ্ত হয়ে সমাজের শান্তি নষ্ট করতে পারে। মহানবী (সা.) দারিদ্র্য ও কুফরি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন।
জাকাতের আর্থ-সামাজিক গুরুত্বের কিছু বিষয় নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
ক. জাকাত সম্পদকে পবিত্র করে : জাকাত মানুষের ধন-সম্পদকে অকল্যাণমুক্ত করে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা (জাকাত) গ্রহণ করুন, এর মাধ্যমে আপনি তাদের পবিত্র করবেন।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০৩)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জাকাত প্রদান করবে, তার সম্পদের অকল্যাণ ও অমঙ্গল দূর হয়ে যায়।’ (তারবানি, হাদিস : ১৬০৮)
খ. জাকাত দারিদ্র্য দূর করে : জাকাতের সাহায্যে গরিবদের জীবনমান উন্নত হয় এবং দারিদ্র্য দূর হয়। সুরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা জাকাতের আটটি খাতের উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে ফকির, মিসকিন, দাস-দাসী এবং ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০.৫ শতাংশ লোক দরিদ্র, আর ২৫ শতাংশ লোক জাকাত দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। যদি সঠিকভাবে জাকাত বিতরণ করা হয়, তবে দারিদ্র্য দূরীকৃত হতে পারে।
গ. জাকাত উৎপাদন বৃদ্ধি করে : জাকাতের মাধ্যমে গরিবদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ফলে চাহিদা বেড়ে যায়। এর মাধ্যমে উৎপাদন এবং বাজারের গতি বৃদ্ধি পায়।
ঘ. জাকাত অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে : জাকাত ধনীদের সম্পদকে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে, যা সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করে।
ঙ. জাকাত সমাজে শান্তি আনয়ন করে : জাকাতের মাধ্যমে সমাজে দরিদ্র ও গরিবদের সাহায্য পৌঁছালে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিরোধ কমে যায়।
দারিদ্র্য বিমোচন ও জাকাত
জাকাত মানবতার মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং অভাব দূর করার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ইসলাম গরিবদের খাদ্য এবং মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য কঠোরভাবে জাকাত প্রদান করতে বলেছেন।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সে প্রকৃত মুসলমান নয়, যে তার প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজের উদরপূর্তি করে।’
অতএব, ইসলামের মূলনীতি এবং সমাজের শান্তি ও উন্নতির লক্ষ্যে মুসলমানদের উচিত সঠিকভাবে জাকাত আদায় করা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাবেক অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, স্ট্যান্ডার্ড (ইসলামী) ব্যাংক।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta