শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন ও ইসলাম : প্রয়োজন সমন্বিত পদ্ধতি
শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতিফলন এবং এর মাধ্যমে একটি জাতির অগ্রগতি, উন্নয়ন এবং সংকট মোকাবিলার পথ নির্দেশিত হয়। তাই শিক্ষায় জাতির মনন, বুদ্ধিবৃত্তি ও হৃদয়ের প্রতিফলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের শিক্ষা খাত বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও এর প্রকৃত বিকাশ খুবই সীমিত। দেশের চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী এবং ১৩ লাখের মতো শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছে। এছাড়া রয়েছে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কারিগরি, মাদরাসা ও কওমি মাদরাসা, এবং উচ্চ শিক্ষা। এতে মক্তব ও ফোরকানিয়া মাদরাসাও অন্তর্ভুক্ত, যেখানে প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হয়। বিদেশী কারিকুলাম অনুসারে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের কথা উল্লেখ করতে হবে। এই বৈচিত্র্যময় শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষার বিপুল সংখ্যা সমন্বয় এবং সংস্কারের খুব প্রয়োজন, যাতে ইসলামী শিক্ষার যথাযথ অন্তর্ভুক্তি সম্ভব হয়।
তবে, এই প্রক্রিয়া কতটা এগিয়েছে? স্বাধীনতার পর আমরা অন্তত ৯টি শিক্ষা কমিশন দেখেছি। ১৯৭২ সালের কুদরত-ই খোদা শিক্ষা কমিশন থেকে শুরু করে ২০২১ সালের জাতীয় শিক্ষাক্রম। কমিশনগুলোর ভাবনা মূলত কুদরত-ই খোদা কমিশনের প্রভাবিত ছিল। সেই চিন্তা এখনও চলছে। ২০২১ সালে আওয়ামী সরকারের গঠিত কমিশন যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রস্তাব করেছিল, তা জাতীয় জীবনে বিতর্ক ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকার সেই রূপরেখা বাতিল করে, কিন্তু নতুন কোনো রূপকল্প গ্রহণ করেনি; বরং ২০১২ সালের সৃজনশীল শিক্ষাক্রমের ওপর ভিত্তি করে পাঠ্যপুস্তক সংস্কার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়।
এ সরকারের কাছে জাতির প্রত্যাশা ছিল যে তারা শিক্ষা কমিশন গঠন করবে এবং জাতির উন্নয়নের জন্য গুণগত পরিবর্তন ঘটাবে। সরকারের দায়িত্ব ছিল জাতির বিশ্বাস, ঐতিহ্য, মনন, দক্ষতা ও মানব-উন্নয়নকে সঠিকভাবে সমন্বিত করা।
বিগত স্বৈরতন্ত্র শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে অবক্ষয় ঘটিয়েছে এবং জ্ঞান ও দক্ষতার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে ডিগ্রি ও জিপিএ বিতরণ করেছে। পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে, ইসলামী শিক্ষার সঙ্কোচন করা হয়েছে, ইসলামবিরোধী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এবং হিন্দুত্ববাদী ধারণা ও এলজিবিটিকিউ প্রচার করা হয়েছে।
এছাড়াও, শিক্ষার মানও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল থেকেই প্রতিফলিত হয়। ২০২৪ সালে ‘ক’ ইউনিটে (বিজ্ঞান) পাসের হার ছিল মাত্র ৮.৮৯%, আর ‘খ’ ইউনিটে (কলাশাস্ত্র) পাসের হার ছিল মাত্র ১০.০৭%।
সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে তিনটি বিষয় বলা হয়েছে: ১. আইনানুযায়ী; ২. সর্বজনীন, গণমুখী এবং ৩. অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা। তবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি, এখানে শিক্ষা অপ্রতুল এবং ধর্মীয় শিক্ষা খুবই সীমিত। মুসলিম ছাত্রদের ফরজ ধর্মীয় শিক্ষা সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
কমিশনগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, তবে মৌলিক দৃষ্টি ও সৃষ্টির অভাবে তা সঠিক ফলাফল দিতে পারেনি। কোনো কমিশনই মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে কার্যকর উপাদানগুলো নিশ্চিত করেনি। বরং একপেশে শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, যা জাতিসত্তার সাথে সাংঘর্ষিক।
শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন একটি দক্ষ, নৈতিক এবং মানবিক প্রজন্ম গঠনের জন্য জরুরি। ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে জাতীয় বিনির্মাণের জন্য শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই শিক্ষানীতি ধর্মীয় মূল্যবোধ, জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা এবং একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার দক্ষতা নিশ্চিত করবে। এখানে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে শিক্ষাদর্শন, শিক্ষার ভিশন, মিশন এবং উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হবে।
শিক্ষাদর্শন সঠিক না হলে, শিক্ষা অন্যথায় পথ হারাবে। শিক্ষাদর্শন কেবল ইহজাগতিক নয়, বরং এতে ধর্মীয় দিকনির্দেশনা থাকতে হবে, যাতে নৈতিকতা, মানবিক গুণাবলী এবং ব্যক্তিগত কল্যাণ নিশ্চিত হয়। এটি কেবল বৈজ্ঞানিক-প্রযুক্তিগত নয়, বরং নৈতিক এবং মানবিক দিক থেকেও গঠনমূলক হতে হবে।
শিক্ষার রূপকল্প হবে সর্বজনীন, যা সবার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা এবং দক্ষতা ও মানবিক উন্নয়নের জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষা প্রদান করা।
জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য হবে ‘দেশীয় সত্তা ও মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়ে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠন’।
শিক্ষার পাঠ্যক্রম নিশ্চিত করবে দুটি বিষয়: ১. জ্ঞান এবং ২. দক্ষতা। জ্ঞান হবে আসমানি এবং অর্জিত জ্ঞানের মিশ্রণ, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং দার্শনিক চিন্তার ফলস্বরূপ।
দক্ষতা হবে মৌলিক, উচ্চতর চিন্তা, এবং সংবেদনশীল দক্ষতার মিশ্রণ। শিক্ষার্থীরা বৈজ্ঞানিক এবং নৈতিক দিক থেকে দক্ষতা অর্জন করবে, যা তাদের দেহ, মন এবং আত্মার সমন্বিত বিকাশ ঘটাবে।
বাংলাদেশে ধর্মশিক্ষাকে গৌণ করা যাবে না। মাদরাসা শিক্ষায় মানোন্নয়ন অপরিহার্য। ইসলামী শিক্ষা একটি সুষ্ঠু, নৈতিক এবং সৃজনশীল জাতি গঠনে সহায়ক হতে পারে।
লেখক: কবি, গবেষক
[email protected]
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta