তালেবান মার্কিন প্রভাবের মোকাবেলা করছে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তানে ফেলে আসা মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র দ্রুত ফেরত আনার জন্য তালেবান সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে তালেবান জানিয়েছে, তারা ওই অস্ত্র ফেরত দিতে রাজি নয়, এমনকি এর জন্য বিলিয়ন ডলার দিলেও সেগুলো তাদের সরকারের সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। পশ্চিমা দেশগুলো সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান সরকারের শাসন ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে কিংবা তাদের শাসনদ্বারা প্রভাবিত করতে পারেনি, যদিও আফগানিস্তান পুনর্গঠন ফান্ডে অনেক টাকা খরচ করা হয়েছে। ট্রাম্পের অস্ত্র ফেরতের আহ্বানের পর আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ জব্দ করাকে কেন্দ্র করে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে।
২০২১ সালের ১৪ আগস্ট, যখন আমেরিকার শেষ সামরিক বিমানটি কাবুল ছাড়ে, তখন তালেবান কাবুলে প্রবেশ করে। ওইদিনই কাবুলে সামরিক ও বেসামরিক উদ্ধার অভিযান চলছিল। যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ম্যাকেঞ্জি বলেছেন, এক লাখ ২৩ হাজার বেসামরিক মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার পাঁচশো মানুষ কাবুল ছাড়তে সক্ষম হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘এটি নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা।’ তালেবান কাবুল দখল করার পর, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তানের ৭ বিলিয়ন ডলার জব্দ করেন, পরবর্তীতে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তার জন্য স্থানান্তর করা হয়। তবে সেগুলো এখনও তালেবানের হাতে পৌঁছায়নি। এই তহবিল এখন প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। তালেবান সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দিতে দাবি জানাচ্ছে। উভয় পক্ষই বিরোধপূর্ণ দাবিতে অটল রয়েছে।
তালেবান সরকারের কাছ থেকে ফেরত চাওয়া যেসব অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ৭৮টি বিমান, ৪০ হাজার সামরিক যান, তিন লাখের বেশি অ্যাসল্ট রাইফেল, যুদ্ধাস্ত্র, যোগাযোগ যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম। এই যুদ্ধ সরঞ্জামের মূল্য প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার। সেনা চলে যাওয়ার সময় বহু যুদ্ধযান অকেজো করা হয়েছিল, তবে তালেবান এসব পুনরায় চালু করেছে। ট্রাম্প অস্ত্র ফেরত না পেলে কাবুলে আক্রমণ চালাতে পারেন এমন গুঞ্জন শোনা গেলেও তার প্রথম মেয়াদে দোহা চুক্তিতে সাক্ষর করার পর, তিনি আরেকটি যুদ্ধের চেয়ে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।
আফগানিস্তানে লিথিয়াম, তামা এবং বিরল খনিজসমৃদ্ধ সম্পদ রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমাতে পারে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আফগানিস্তানকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাজারে একীভূত করতে সহায়তা করবে। চীন ও রাশিয়া আফগানিস্তানের খনন ও অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে, যা তালেবানকে সহায়তা করেছে। আফগানিস্তানে চীনের উপস্থিতি বিশেষ কৌশলগত গুরুত্ব পেয়ে উঠেছে। আফগানিস্তান চীনের বিআরআই-এর অংশ, যা এশিয়া ও বাইরের যোগাযোগ রুট উন্নত করতে সাহায্য করবে। চীন আফগানিস্তানে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে পশ্চিমা শক্তির প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করছে।
মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে, বিশেষত যেহেতু তা বিশ্ববাজারে প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ রুট। এসব দেশ আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতার শঙ্কা প্রকাশ করেছে, বিশেষ করে শরণার্থী প্রবাহ, সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থা নিয়ে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলো সিএসটিও এবং এসসিও এর মতো নিরাপত্তা জোটে সদস্য হয়ে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়াচ্ছে।
ইরান ও তালেবানদের সম্পর্ক জটিল। ১৯৯০ এর দশকে তালেবানের শাসনকালে ইরান ছিল তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ, তবে বর্তমানে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় ইরান তালেবানের সঙ্গে সহযোগিতা করছে। আফগানিস্তানে ইসলামিক স্টেটের উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন, ইরান তালেবানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। ইরান তাদের স্বার্থ রক্ষায় তালেবানের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে।
তালেবান মার্কিন অস্ত্র ফেরত দেওয়ার ট্রাম্পের নির্দেশ মানেনি, বরং নিজের শক্তি ও দাবি প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা তাদের বিজয় দিবসে বন্দী অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরও উন্নত অস্ত্র সরবরাহ করার পরামর্শ দিয়েছে। তাদের এই অস্বীকৃতি তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বাইরের চাপ সহ্য করার সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta