বারেক ফিরে দেখা : সত্তরের নির্বাচন
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ৩০০টি আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ১৬২টি ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ও ১৩৮টি পশ্চিম পাকিস্তানে। এছাড়া, নারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল ১৩টি আসন, যার মধ্যে সাতটি পূর্ব পাকিস্তানে ও ছয়টি পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান-ভিত্তিক পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ও পূর্ব পাকিস্তান-ভিত্তিক আওয়ামী লীগের মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের একক আধিপত্য থাকলেও, পশ্চিম পাকিস্তানে পিপিপিকে মুসলিম লীগসহ বিভিন্ন রক্ষণশীল দলের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হয়েছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একতরফা বিজয় লাভ করে। দলটি ১৬২টি সাধারণ আসনের মধ্যে ১৬০টি এবং সংরক্ষিত সাতটি নারী আসনও দখলে নেয়। অন্যদিকে, পিপিপি পশ্চিম পাকিস্তানে ৮১টি সাধারণ আসন ও পাঁচটি নারী আসন জিতে। প্রাদেশিক নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখে, আর পিপিপি শুধুমাত্র পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে শক্ত অবস্থানে ছিল।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পিপিপি চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানের একক নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হননি, ফলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেননি। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের বাইরের বিজয়ী নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। অধিবেশন আহ্বানে বিলম্বের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তোষ বাড়তে থাকে, যা চূড়ান্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিকে গড়ায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইয়াহিয়া খান পদত্যাগ করে ক্ষমতা ভুট্টোর হাতে তুলে দেন।
১৯৫৪ সালে গঠিত পশ্চিম পাকিস্তানের একীভূত প্রদেশটি ভেঙে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নামে চারটি প্রদেশ গঠন করা হয়। জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে অর্ধেকের বেশি আসন পেয়েছিল। নির্বাচনের এক মাস আগে ভোলায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়, যাতে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বল প্রতিক্রিয়ায় জনগণের অসন্তোষ আরও বাড়ে।
১৯৭১ সালের মে মাসে সিআইএ একটি গোপন প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে উল্লেখ ছিল, পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হলে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়বে। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের পণ্যের বিকল্প বাজার খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। তারা আরও জানায়, পূর্ব পাকিস্তানের ওপর বাণিজ্যিক নির্ভরতা যত বাড়ছিল, দুই অঞ্চলের আর্থিক বৈষম্য তত বাড়ছিল। বিশেষ করে ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় দেখিয়ে দেয় পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা।
১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের প্রথম সরাসরি সাধারণ নির্বাচন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগের একমাত্র নির্বাচন। বিচারপতি আবদুস সাত্তার পাকিস্তানের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনের জেরে পূর্ব পাকিস্তানে দমনপীড়ন ও গণহত্যার সূচনা হলে তাকে পদচ্যুত করা হয় এবং ইসলামাবাদে গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৭৩ সালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং পরবর্তীতে সপ্তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
নির্বাচনে ২৪টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। পিপিপি পূর্ব পাকিস্তানে কোনো আসন জিততে পারেনি, আর আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যর্থ হয়। ভুট্টো দাবি করেন, মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের সমর্থন পাননি, যদিও পিপিপিও পূর্ব পাকিস্তানে শূন্য আসনে ছিল। নির্বাচনের পর ভুট্টো মন্তব্য করেন, ‘ইধার হাম, উদার তুম’, যা কার্যত পাকিস্তান বিভক্তির ইঙ্গিত বহন করেছিল।
জাতীয় পরিষদের ৩০০টি আসনের জন্য ১,৫৭৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আওয়ামী লীগ ১৭০টি প্রার্থী মনোনীত করেছিল, যার ১৬২ জন ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। এদের ৪৮% ছিলেন আইনজীবী, ১৯% ব্যবসায়ী, এবং ৬% শিক্ষক। জামায়াতে ইসলামীর ১৫১ জন, পিপিপির ১২০ জন, এবং মুসলিম লীগের বিভিন্ন অংশের মোট ৩৭৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে প্রায় ৬৫% ভোটার উপস্থিতি ছিল।
নির্বাচনী প্রচারণায় একটি পোস্টার জনপ্রিয় হয়: ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ এটি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বঞ্চনার প্রতিফলন তুলে ধরে। হায়দার আকবর খান রনো তার বইয়ে লিখেছেন, আওয়ামী লীগের বিপরীতে দক্ষিণপন্থী দলগুলো দাঁড়াতেই পারেনি।
মওলানা ভাসানী প্রথমে নির্বাচন করতে রাজি হলেও পরে তা বর্জনের ঘোষণা দেন। অনেকের মতে, তিনি নির্বাচনে অংশ নিলে ভোট বিভক্ত হতো এবং আওয়ামী লীগ একচ্ছত্র জয় পেত না। তবে রনোর মতে, ভাসানী ইচ্ছাকৃতভাবে মুজিবকে পথ সুগম করে দিতে চেয়েছিলেন, যাতে স্বাধীনতার বিষয়টি সহজ হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচন ইয়াহিয়া সরকারের ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মন্ত্রিসভার কেউ অংশ নিতে পারেনি। বিচারপতি সাত্তার নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর তৎকালীন মুখপাত্র সিদ্দিক সালিক তার বইতে উল্লেখ করেছেন, ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচন ছিল কেবল আনুষ্ঠানিকতা। জনগণের রায় দুই অংশের রাজনৈতিক চিন্তায় স্পষ্ট পার্থক্য দেখায়।
নির্বাচনের পর সংকট আরও ঘনীভূত হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে একক প্রদেশ হিসেবে গণ্য করা হলেও পশ্চিম পাকিস্তান চারটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। ভুট্টো প্রশ্ন তোলেন, একটি প্রদেশের নেতা পুরো পাকিস্তান কীভাবে শাসন করবেন? প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন, যার ফলে শেখ মুজিব অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্যের শিকার হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। যদিও জনসংখ্যার ৫৬% ছিল পূর্ব পাকিস্তানে, তবে সব ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত ছিল।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ব্রুস রিডেল তার বইতে লিখেছেন, পাকিস্তান শুরু থেকেই পূর্ব বাংলাকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখত, যা ২৫ বছরে বাঙালিদের সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর দূরত্ব আরও বাড়ায় এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে দেয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ গবেষক জেনিফার কোটস তার বইতে উল্লেখ করেন, পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের পর বাঙালি সংস্কৃতি কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পড়ে।
পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে দুর্বল করতে নানা পদক্ষেপ নেয়। ১৯৬১ সালে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়।
লেখক: সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta