রাজনীতির ভাষা
২০১৯ সালের ৪ জুলাই ‘আইনজীবীর ভাষা’ শিরোনামে একটি কলামে আলোচনা করেছিলাম। সেখানে বলেছিলাম, কিছু আইনজীবী তাদের ব্যবসা বাড়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে সহজ ভাষাকে জটিল করে তোলেন, যেমনটা অনেক ধর্মীয় নেতা করেন। উদাহরণ হিসেবে, ভারতবর্ষের বর্ণদ্বিজরা ভাষার মাধ্যমে বর্ণবৈষম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন। যদিও ভারতবর্ষে সংস্কৃত ভাষাভাষী জাতি ছিল না, তবুও তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো সংস্কৃত ভাষাতেই পরিচালিত হত। সনাতন ধর্মের ব্রাহ্মণ বা পুরোহিতরা তাদের ভাষাকে কঠিন করে সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের এবং ধর্মকে আড়াল করে রাখতেন। একই মনোভাব কিছু আইনজীবী আদালতেও প্রয়োগ করেন। তারা অহেতুক ইংরেজি ব্যবহার করে আইনের ভাষাকে দুর্বোধ্য করার চেষ্টা করেন।
এই শ্রেণীর আইনজীবী ও ধর্মীয় নেতাদের মতো রাজনীতিবিদদেরও নিজস্ব ভাষা থাকে। হাজার চেষ্টা করেও রাজনীতির ভাষা আয়ত্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আর তাই বারবার অপমানিত হওয়ার পর আমি নিজেকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নিয়েছি।
কুমিল্লাকে রাজনীতিবিদদের জন্য রত্নগর্ভা বলা যায়। যখনই কোন দল ক্ষমতায় আসে, তখনই কুমিল্লায় মন্ত্রী-মিনিস্টারের সংখ্যা বেড়ে যায়। বিএনপির সময় মেঘনা এলাকায় দুই রাজনৈতিক নেতার আধিপত্য ছিল। আমি একসময় ভাবতাম, মন্ত্রী-মিনিস্টাররা সাধারণ মানুষ নন, কিন্তু এম কে আনোয়ার সে ভুলটা ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি যখন মন্ত্রী ছিলেন, তার অফিসে মাঝে মধ্যে যেতাম এবং একসময় আমি পরিচিত হয়ে উঠি, কারণ আমি বাংলা সাহিত্য পড়াশোনা করতাম। এম কে আনোয়ারের কাছে গেলে আমি দেখতে পেতাম, তার সামনে দুটো খালি চেয়ার রাখা থাকত। যখন কাউকে তিনি ডাকতেন, তখন তাকে সামনের চেয়ারে বসতে দিতেন। তেল দেওয়া মানুষের কাছে তিনি বিরক্ত হতেন।
এক সময় এম কে আনোয়ারের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একবার তিনি ও থানার কমিটির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম সিরাজের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছিল। আমরা বিএনপি নেতারা সিরাজের বাসায় গিয়ে মন্ত্রীকে বাসায় আসার জন্য অনুরোধ করি। তার একরোখা মনোভাব দেখে আমি তাকে বলেছিলাম, ‘আপনি যদি পূর্ণিমার চাঁদ হন, মন্ত্রী সূর্য। আমরা আপনাকে সম্মানের সাথে মন্ত্রীর কাছে নিয়ে যেতে এসেছি।’ এরপর তিনি আমাদের সাথে যেতে সম্মত হন।
এম কে আনোয়ারের মতোই, খন্দকার মোশাররফ হোসেন রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তিনি একজন ভালো লেখকও। তার জীবনী লেখার দায়িত্বও আমাকে দিয়েছিলেন। যখন দলীয় নির্বাচনের বছর ছিল, তিনি আমাকে শেষ বক্তা হিসেবে দাঁড়াতে বলেছিলেন। আমি খোলামেলা আলোচনা করলাম, কিন্তু দলের সাধারণ প্রশংসা না করে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরায় সমালোচিত হলাম। এরপর আমি রাজনীতি থেকে সরে যাই।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমি জানলাম যে আমি এখনো উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। যদিও সম্মেলনে গিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য শুনতে পারলাম না, কারণ তিনি আগে চলে গেছেন। সভার বাকিরা দলীয় প্রশংসা করছিলেন। এর মাঝে, আমি একসময় মনে পড়েছিলাম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে মেঘনা ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বক্তৃতা দিচ্ছিলাম। সেদিনও আমি দলের নেতার গুণকীর্তন না করে দলের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছিলাম, যা নেতার পছন্দ হয়নি।
রাজনীতির ভাষা এমন যে, স্তুতি ও প্রশংসা সীমাহীন হতে থাকে এবং এতে একজন মানুষ তার প্রকৃত অবস্থান ভুলে যেতে পারেন। যতই একে প্রভু মনে করা হোক, একজন নেতার পতন তখনই অনিবার্য হয়ে পড়ে। সেই ভাষা, যা নেতা খুশি হবেন, তা রাজনীতির ভাষা।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta