ছাত্র-রাজনীতি থেকে বিরত থাকা
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী এবং চলমান পরিস্থিতি নিয়ে নাগরিক সমাজ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানানো হচ্ছে। ছাত্রদের গৌরবময় আন্দোলনের কিছু দিন পরই বিভিন্ন ক্যাম্পাসে অনিয়মের ঘটনা ঘটছে, যা আসলে ছাত্ররাজনীতির অংশ নয়, বরং অ-ছাত্ররাজনীতির ফল। বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বৈরাচারী সরকার ও ছাত্ররাজনীতির এই ধরন কাম্য নয়। কুয়েটের অস্থিতিশীলতা, ছাত্র সংগঠনগুলির সংঘর্ষ এবং একাডেমিক বিষয়ে ছাত্র নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণযোগ্য নয়। ছাত্র নেতৃত্বের অবস্থান প্রতিশ্রুতিশীল হওয়ার কথা, কিন্তু তা ঠিক বিপরীত ঘটছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে!
সর্বশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-কুয়েট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অনুমতি নেই। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিতে ছাত্রদল এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে, যাতে শতাধিক ছাত্র আহত হন। পরবর্তীতে সাধারণ ছাত্ররা উপাচার্যকে ২৪ ঘণ্টার জন্য অবরুদ্ধ করেন। কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি অনেক আগেই নিষিদ্ধ, তবে ঘটনার দিন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল লিফলেট বিতরণ করে, যা সাধারণ ছাত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে রয়েছে। হামলা এবং সংঘর্ষ নিয়ে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ চলেছে। ছাত্রদল সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অব্যাহতি দাবি করছে, অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছাত্রদলকে দায়ী করছে। সংঘর্ষের সময় যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমানকে রামদা হাতে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য বহিষ্কার করা হয়, যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। কুয়েটে পরিস্থিতি এখনও উত্তেজনাপূর্ণ।
এদিকে, গত কয়েক মাস ধরে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা বেড়েছে, যা ক্যাম্পাসগুলোকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। সাধারণ মানুষ এবং ছাত্রদের মধ্যে আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি শক্তিশালী ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে। এই ত্রিমুখী সংঘর্ষ ছাত্ররাজনীতিতে নতুন পরিস্থিতি তৈরি করছে। তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেওয়ায় ছাত্ররাজনীতি ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে। বিপ্লবের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, তবে ছাত্রশিবির কিছু ক্যাম্পাসে এখনও ভালো অবস্থানে রয়েছে। ছাত্রদল সাধারণভাবে জনপ্রিয় হলেও নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে পারছে না। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও শিবির ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলছে, যার ফলে ছাত্রদল নির্বাচনের পরে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারে, তাই ছাত্রদল নির্বাচনের সময় পিছানোর চেষ্টা করছে। পাশাপাশি নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এবং আদর্শিক দূরত্বের বিষয় রয়েছে।
একটি গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লব সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। অনেক সময় এই অস্থিরতা অরাজকতায় পরিণত হয়। বাংলাদেশে ছাত্রসমাজের অবস্থাও কিছুটা এরকম। বিপ্লবের পর ছাত্রদের ক্লাসে ফিরিয়ে নেওয়া জরুরি ছিল। এ ক্ষেত্রে ছাত্রনেতৃত্ব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু তারা এই দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ছাত্ররা রাজনীতির দিকে ঝুঁকছে। ঢাকা কলেজ এবং আশেপাশের এলাকা এখন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। পুরান ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ এবং শামসুল হক কলেজ পরস্পর শক্তি প্রদর্শনের আয়োজন করছে। মানুষের ধারণা, কর্মসূচি না থাকলে তাদের কিছু করতে হবে।
জনগণের মতো ছাত্রদেরও দাবি বেড়ে চলেছে। তারা পরীক্ষার মাধ্যমে পাস করতে চায়। সরকারের পক্ষ থেকে তাই মেনে নেওয়া হচ্ছে। ছাত্ররা সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং ঢাকা শহর অচল করে দিয়েছে। তারা তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি করছে। সরকার অনেক অযৌক্তিক দাবিতে মাথা নত করেছে। ছাত্ররা দেখছে যে, আন্দোলনের মাধ্যমে তারা সবকিছু আদায় করতে পারে। এভাবে ছাত্ররাজনীতির বিপদাপদ দাবি-দাওয়ার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।
এছাড়া নানা দাবি নিয়ে ছাত্ররা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অচল করে তুলছে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে। আগে মুক্তিযোদ্ধা, খেলোয়াড় এবং পোষ্য কোটা ছিল। এটি পিয়ন থেকে শুরু করে অধ্যাপক পর্যন্ত বিস্তৃত। একটি নির্দিষ্ট মান পূরণ না হলে পোষ্যকোটা প্রযোজ্য নয়। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগরে এ নিয়ে আন্দোলন চলছে। কিছু ক্ষেত্রে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় চাপ সৃষ্টি করছে। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি ভালো নয়। এসব কর্মকাণ্ডকে আর ছাত্ররাজনীতি বলা যায় না।
নিঃসন্দেহে ছাত্ররাজনীতির একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রয়েছে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তা ধারণ করে না। পূর্বোক্ত আলোচনা এটি প্রমাণ করে। কুয়েটের ঘটনা তার সাক্ষ্য। এই অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। এর একটি সঠিক সমাধান প্রয়োজন, যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যক্রম দ্বারা নির্দেশিত।
ছাত্ররাজনীতির নামে ছাত্রলীগ গত দুই দশকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে, তাতে সাধারণ ছাত্রসমাজের মধ্যে নিরাসক্তি সৃষ্টি হয়েছে। বুয়েটের আবরারের মৃত্যু ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। ছাত্ররা আর ছাত্ররাজনীতি চায় না। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জনমত জরিপের সুযোগ থাকত, তবে এ নিয়ে প্রমাণ মিলত। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর দাবি উঠেছিল, ছাত্ররাজনীতির লেজুড়বৃত্তি নিষিদ্ধ হোক। সচেতন নাগরিকরা এ দাবির পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। যদি সমস্যার সমাধান জরুরি হয়, তাহলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। তবে এর মানে এই নয় যে, ছাত্ররা রাজনীতি থেকে বিরত থাকবে। তারা রাজনীতি করবে, কিন্তু দলের লেজুড়বৃত্তি নয়। বর্তমানে রাজনৈতিক দলের অনুমোদনক্রমে ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত নয়। ছাত্ররাজনীতি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হতে হবে, তাদের আদর্শিক সম্পর্ক থাকতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতার উত্থান ও পতনে ছাত্রদের কোন ভূমিকা থাকবে না। কিছু রাজনীতিবিদ এবং সচেতন ব্যক্তি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে। তাদের যুক্তিও আছে। তবে বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির যে অবস্থা, তাতে সমস্যা সমাধানের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
আমরা এখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সময় পার করছি। ভবিষ্যতে একটি নির্বাচিত সরকার আসবে। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক সরকার ছাত্রদেরকে আরও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করবে। যদি আমাদের পূর্বোক্ত তিন পক্ষের লড়াই অব্যাহত থাকে, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি খারাপ হবে। উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের মন্তব্যে বিষয়টি প্রতিফলিত হয়। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী আমলে লীগ ও অন্য যেকোনো পক্ষের মধ্যে মারামারির হলে পুলিশ-প্রশাসন লীগ পক্ষেই থাকত। কিন্তু বর্তমানে পুলিশ-প্রশাসন বিভক্ত, তাই কোন পক্ষই সহজে পিছাবে না। উভয়ই নিজেদের অস্তিত্বের জন্য লড়বে। হয়তো ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে সর্বোচ্চ হতাহতের ঘটনা ঘটবে। এসব দেখে হতাশ লাগে। আমি কখনো ভয় পাইনি, তবে যখন দেখি আমার ভাইয়েরা একে অপরের রক্তে মেতে উঠছে, তখন সত্যি ভয় লাগে। এখানে যে পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তারা তো আমার ভাই। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের একে অপরকে দোষারোপ ও হুমকি-ধমকি দেওয়ার প্রক্রিয়া ভবিষ্যতের জন্য সংকেত দিচ্ছে। সিনিয়রদের হস্তক্ষেপ জরুরি। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন, সঠিক জ্ঞান দান করুন। আমীন।’
আসিফ নজরুলের উদ্বেগের সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। তার উদ্বেগ প্রতিটি সচেতন মানুষের। দেশের স্বার্থে ছাত্ররাজনীতি তথা লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকার ইচ্ছা করলে ছাত্রনেতৃত্ব ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। মনে রাখতে হবে, কঠিন সময়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার মধ্যেই রয়েছে সার্থকতা।
লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta