শীতকালে পল্লী স্মৃতি
পৌষ-মাঘ শীতকাল। শীতের সকালে লেপ মুড়িয়ে ঘুমানো বেশ আনন্দের। ঘুমের মধ্যে কখনও কখনও স্বপ্ন দেখতাম বড় হওয়ার। শৈশবকালে শুনেছিলাম যে আমি ফুটবল পছন্দ করতাম। তাই লেপের ভিতর ঘুমানোর সময় ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখতাম এবং বলতাম- "ঐধভ নধষষ রং মড়রহম।" কেন বলতাম, সেটা ঠিক মনে নেই। পরে, হাইস্কুলে গিয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করি। শীতের সকালে শিশির পড়া ঘাসে সূর্যের কিরণে মুক্তা দানার মতো জ্বলে ওঠে। আমাদের জমিতে ছিল খেজুর গাছ, যার রস প্রতিদিন বাড়িতে আসত। কখনও উলা রস, কখনও জিরিন রস। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে মাদুর পেতে বসতাম।
ঠাণ্ডায় গা হাত পা আড়ষ্ট হয়ে যেত। সকালে রোদটা যেন সোনার চেয়েও মূল্যবান। তারপর আসত জিরিন রস খাওয়ার সময়। বাঁকা স্টিলের গ্লাসে দুই গ্লাস জিরিন রস খাওয়া ছাড়া সকালের দিনটা ভালো লাগত না। গ্রামের লোকজন সকালে আগুন পুড়িয়ে গরম হয়ে উঠত। তারা খড়, কাগজ, বিচুলি দিয়ে আগুন জ্বালাত। তারপর শুরু হতো হাত পা গরম করা। চারপাশে কুয়াশা থাকত, যার মধ্যে মানুষের মুখ চিনতে কষ্ট হত। শীত এবং কুয়াশার এই মিশ্রণ এক আলাদা অনুভূতি তৈরি করত। গোসলের জন্য পানি গরম করা হতো। শীতের পোশাক, টুপি, চাদর পরার রেওয়াজ ছিল। মাঝে মাঝে কম্বল বা জাম্পারও পরা হত। যখন রোদ একটু তেজিয়ে উঠত, আমরা মাদুর থেকে উঠে ঘরে গিয়ে সকালের খাবার খেয়ে স্কুলে যেতাম। শীতে আমাদের শিক্ষকরা জ্যাকেট ও টুপি পরে আসতেন এবং মাঠে রোদে আমাদের পড়াতেন। জানুয়ারিতে নতুন বছর শুরু হলে নতুন বই পেতাম। নতুন বইয়ের গন্ধে মন ভরে যেত। এখনো মনে পড়ে একটি কবিতা, যা গ্রামকেন্দ্রিক ছিল এবং সেটি আরও বেশি স্মরণীয় হয়ে ওঠে।
সকালে খেজুরের রস জ্বাল দেওয়ার পালা আসত। তারপর গুড় পাটালি খাওয়ার স্বাদ ছিল অন্যরকম। খেজুরের রসে পাটি শাপটা পিঠা ভিজানো এবং কাগজি লেবুর পাতা ও এলাচ মিশিয়ে সৌরভ আরও বাড়িয়ে দিত। ভাপা, পুলি, পাটি শাপটা পিঠা সব বাড়িতে একসাথে তৈরি হত এবং আনন্দের স্রোত সৃষ্টি হতো। আমাদের বাড়িতে ছিল চারটি গাভী। গাভীর দুধ কখনও শেষ হত না। স্কুল থেকে এসে দুপুরে দুধের ক্রিম খাওয়া হতো, যা ছিল মধুর ও পুষ্টিকর। শীতের রাতে হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করতাম, যেটি ছিল আমাদের একমাত্র আলোর উৎস। গভীর রাতে শিশির পড়ত এবং লেপের ভিতর ঘুমানোর প্রস্তুতি চলত। মাঝে মাঝে গরম পানি পাওয়া যেত।
শীতের রাতে বুড়ো স্যারের কাছে পড়তাম। ১৫-২০টি পরিবারে শিশুরা একত্রিত হয়ে চেয়ারম্যান নানার বাড়িতে পড়তে যেত। বুড়ো স্যারের লাঠি ছিল বাঁশের তৈরি, যেটি মাঝে মাঝে তৈল দিয়ে মালিশ করা হতো। তিনি শৃঙ্খলা ও পড়াশোনা নিয়ে আমাদের শিক্ষা দিতেন। শীতের সময় মিলাদ মাহফিলও হতো, যেখানে আমরা সুজি খেতাম। কলার পাতায় খাবার পরিবেশন করা হত যখন প্লেট না পাওয়া যেত।
শীতকালে মাঠে শীতকালীন সবজি চাষ হতো। পেঁয়াজ, সরিষা, গোল আলু, গম সব চাষ হতো। পানি সেচের জন্য নলকূপের ওপর নির্ভর করা হত। সরিষা ক্ষেতগুলো ছিল চোখ ধাঁধানো। শীতের সময় গমের ক্ষেত পাখি তাড়ানোর জন্য আমরা একত্রিত হতাম। আলু তোলার সময় মাটির ভেতর ভরে চুলার আগুনে রেখে খেতাম। শীতকালে স্কাউট প্রশিক্ষণ চলত এবং আমরা জেলা ফার্স্ট হয়েছিলাম। শীতের দিনগুলো স্মৃতির খাতা হয়ে ওঠে। আশা করি শীতের প্রকৃতির বিবর্ণতা আমাদের জীবনে নতুন রঙ আনবে।
লেখক : প্রভাষক - দর্শন বিভাগ
সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta