বায়োস্কোপ
বায়োস্কোপের সাথে বাঙালি সমাজের পরিচয় নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে গ্রামীণ জীবনে বেড়ে ওঠা মানুষের কাছে এটি এক পরিচিত শব্দ। তবে যারা শহরের আবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত, কিংবা যারা সম্প্রতি জন্মেছে, তাদের কাছে এটি হয়তো একটা অদ্ভুত ও হাস্যকর বস্তু হতে পারে। তবে বায়োস্কোপ কখনোই হাস্যকর বা বোকা কোনো বস্তু ছিল না।
আসলে বায়োস্কোপ ছিল গ্রাম বাংলার নিজের সিনেমা হল। রঙিন কাপড়ে সজ্জিত, ঝুনঝুনি হাতে নিয়ে নানা ধরনের গল্প ও দৃশ্য বর্ণনা করতে করতে গ্রামের পথে পথে চলতো। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো পেছন পেছন দৌড়াত গ্রামের ছেলেমেয়েরা। বায়োস্কোপওয়ালার সেই প্রাণবন্ত বর্ণনায় আকৃষ্ট হয়ে গ্রামের পুরুষ-মহিলা সবাই ছুটে আসতো। তবে সবাই একসাথে দেখতে পারতো না, তিন-চারজনের বেশি একসাথে দেখার সুযোগ পেত না। এক শো শেষ হলে, আবার নতুন করে শুরু হতো।
বায়োস্কোপ চলতে থাকলে, ‘কি চমৎকার দেখানো হলো’ বলে আবার শুরু হতো বায়োস্কোপওয়ালার গল্প বলা। আর এর বিনিময়ে তার মাথায় থাকতো কিছু চাল কিংবা দুই টাকা, যা নিয়ে বায়োস্কোপওয়ালা বেশ খুশি হয়ে চলে যেতেন।
সময় পালটে গেছে, আর এখন আর গ্রামে-গঞ্জে বায়োস্কোপ পাওয়া যায় না। টিভি এবং স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে সহজলভ্য বিনোদন এসেছে। তবুও, কোথাও না কোথাও একজন বায়োস্কোপওয়ালা রয়েছেন। যেমন একজন আব্দুল জলিল মণ্ডল।
রাজশাহীর বাঘমারা থানার চায়ের শারা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল জলিল মণ্ডল, যিনি তার বাবার উত্তরসূরি হয়ে বায়োস্কোপ পেশায় জড়িত। তার বাবা বকশি মণ্ডল ৪১ বছর ধরে এই কাজ করতেন, এবং জলিল মাত্র ১০-১২ বছর বয়সে এই পেশায় আসেন। আজ দীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে তিনি এই কাজ করছেন।
জলিল মণ্ডল বলেন, এক সময় গ্রামে-বাজারে বায়োস্কোপ দেখিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন তিনি ও তার বাবা। সেই সময় তিনি ধান, চাল এবং টাকা নিয়ে এই কাজ করতেন। তিনি বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বায়োস্কোপের বিষয়বস্তু পরিবর্তিত হয়েছে, আগে প্রেম কাহিনী, যুদ্ধ, দর্শনীয় স্থান, ধর্মীয় গল্প, ও রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে বায়োস্কোপ দেখানো হত। এজন্য অনেক কিছু জানার প্রয়োজন ছিল।
এখন টেলিভিশন এবং মোবাইল ফোনের বিস্তার ঘটায় বায়োস্কোপের চাহিদা অনেক কমে গেছে। তবে এখনও অনেক মানুষ কৌতূহল নিয়ে এটি দেখতে আসে। জলিল মণ্ডল এখন বিভিন্ন মেলায় বায়োস্কোপ প্রদর্শন করে থাকেন।
তিনি বলেন, আজ থেকে এক যুগ আগে বায়োস্কোপের যে জনপ্রিয়তা ছিল, তা এখন প্রযুক্তির উৎকর্ষে বিলীন হয়ে গেছে। তবে তিনি এখনও বায়োস্কোপকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন, এটি তার জীবিকা ও আনন্দের একটি মাধ্যম।
তিনি বলেন, “এটা আমার পেশা, আগে আমি শিশুদের আনন্দ দিতে পারতাম। বায়োস্কোপটা অনেকের কাছে ছিল এক ধরনের রহস্যময় জিনিস।”
জলিল মণ্ডল জানান, বর্তমানে এক শো দেখতে ২০ টাকা নেয়, তবে তিনি চেষ্টা করেন দর্শকদের আকর্ষণ করতে।
লোক কারুশিল্প মেলায় বায়োস্কোপের উপস্থিতি মানুষকে চমকিত করেছে, বিশেষ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা এর প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
মেলায় আগত দর্শনার্থী সাব্বির আহমেদ পলাশ জানান, তার অতীত বায়োস্কোপের সাথে জড়িয়ে আছে, এবং এটি তাকে পুরনো সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
কুমিল্লার সিরাজুল আলম জানান, তিনি নিজে বায়োস্কোপ দেখেছেন এবং মনে করেন এটি একেবারে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক কাজী মাহবুবুল আলম জানান, মেলার উদ্দেশ্য নতুন প্রজন্মকে বাংলার পুরনো ঐতিহ্য পরিচয় করানো, আর বায়োস্কোপও সেই ঐতিহ্যের অংশ।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta