নির্মল ছৈলারচর
বরিশাল একটি প্রাকৃতিক রত্ন। বরিশাল অঞ্চলের অন্যতম প্রধান নদী বিষখালী। ‘বিষখালীর কন্যা, কাঁঠালিয়া অনন্যা’ এই উপমায় কাঁঠালিয়া উপজেলার বার মৌজার খলিফা হজরত আব্দুল জব্বার মিঞাজী (রহ:)-এর পুণ্যভূমি হেতুলবুনিয়া পয়েন্টে বিষখালী নদীর তীরে একটি বিরাট চর উত্থান ঘটেছে। এই চরটি প্রকৃতি দ্বারা অপূর্বভাবে সাজানো হয়েছে। লাখ লাখ ছৈলাগাছের সৌন্দর্যে চমকপ্রদ হয়ে উঠে ‘ছৈলারচর’ নাম ধারণ করেছে। খরস্রোতা বিষখালী নদী কাঁঠালিয়া উপজেলার জন্য সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র ‘ছৈলারচর’ এর দ্বার উন্মোচন করেছে। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রবাহিত হয়ে ১০০ কিলোমিটার উত্তরে কাঁঠালিয়া সীমান্তে ছৈলারচর অবস্থান করছে। প্রায় দেড় দশক আগে এ চরটির উত্থান হয়েছিল। ২০১৪ সালে কাঁঠালিয়া উপজেলা প্রশাসন এই চরটিকে ‘পর্যটন স্পট’ হিসেবে ঘোষণা করে। বিষখালী নদীর তীরে হেতালবুনিয়া এলাকায় ৫০ একর জায়গা জুড়ে ছৈলারচরের অবস্থান রয়েছে এবং এটি দিন দিন আরও বিস্তৃত হচ্ছে। এখানে ৯৫ শতাংশ ছৈলাগাছ পাওয়া গেলেও কেয়া, হোগল, রানা, এলি, মাদার, বট, খেজুর, গুজিসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ রয়েছে। অপূর্ব রঙিন লাল-সাদা-বেগুনি ছৈলাফুল দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। ছোটরা ছৈলাফুলের মধু খুব পছন্দ করে। এই ফুলের টকজাতীয় কাঁচা-পাকা ফল রান্না করেও খাওয়া যায় এবং ফল দিয়ে জেলি তৈরির সম্ভাবনাও রয়েছে।
ছৈলারচরে রয়েছে ছোট-বড় ছৈলাগাছের সমৃদ্ধ সবুজ বাগান। ছৈলাগাছের শক্তিশালী শিকড় ঝড়-তুফানেও গাছটিকে ভেঙে যেতে দেয় না। এছাড়া, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি যেমন চড়ুই, ডাহুক, বক, ফিঙ্গে, বুলবুলি, মাছরাঙা, ঘুঘু এবং হলদে পাখি গাছের মধ্যে বাসা তৈরি করে। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য সবার মন কেড়ে নেয়। বিষখালী নদী থেকে আসা মৃদু বাতাস ভ্রমণকারীদের শান্তি এনে দেয়। তাই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন পর্যটকরা এখানে পিকনিক করতে আসেন।
বর্ষাকালে জোয়ারের পানিতে চরটির অনেক অংশ ডুবে যায়, তবে শীতে পানি কমে গেলে চরটির সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব হয়। বরিশাল থেকে বরগুনা নৌপথে নৌকা, ট্রলার ও লঞ্চের মাধ্যমে কাঁঠালিয়া-আমুয়ার মাঝখানে হেতালবুনিয়া ছৈলারচরে যাওয়া যায়। সড়কপথে বরিশাল-পাথরঘাটা মহাসড়ক দিয়ে কাঁঠালিয়া বটতলা বাজার থেকে ছৈলারচরে যাওয়া সম্ভব, তবে আমরাবুনিয়া বাজার থেকে বা হেতালবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর সরু কাঁচা-পাকা রাস্তায় যেতে হয়। হেতালবুনিয়া আলিম মাদরাসা পার হওয়ার পর প্রথমেই বিশাল এক মাটির কেল্লা চোখে পড়বে। এরপর রয়েছে সুন্দরভাবে সাজানো ডিসি লেক। ডিসি লেকের ডানে একটি কাঠের ব্রিজ এবং বামে মুক্তিযোদ্ধা ইকোপাক দেখা যাবে। নদী পথে প্রবেশ করতে পাকা সিঁড়ি রয়েছে।
এখানে দর্শনার্থীদের জন্য থাকার ও খাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। বিশ্রামের জন্য এখানে কয়েকটি বিশ্রামাগার যেমন ‘শীতল পরশ’, ‘কিছুক্ষণ’, ‘সাঁঝের মায়া’, ‘জল জোছনা’, ‘দক্ষিণ হাওয়া’, ‘বৃষ্টিবিলাস’, ‘ধানসিঁড়ি’, ‘মৌ বন’, ‘আকাশ নীল’ ইত্যাদি রয়েছে। এছাড়াও, চার-পাঁচটি টং ঘর রয়েছে, লেকে সি-বোট এবং লাইভ জ্যাকেট সহ ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। শিশুদের বিনোদনের জন্য নাগরদোলা, দোলনা, পশু ভাস্কর্য সহ বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে। খাবার পানির জন্য গভীর নলকূপ, টয়লেট এবং রান্নাঘরও রয়েছে।
এখানে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন, কাঁঠালিয়া জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করছে। তবে, পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ছৈলারচরকে দেশের আরেকটি জনপ্রিয় পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে। ছৈলারচরকে জাতীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হলে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পানি ও স্থলপথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা, দর্শনার্থীদের জন্য রেস্ট হাউজ, খেলার মাঠ এবং বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা একান্ত প্রয়োজন। ছৈলারচর একদিন দেশের পর্যটন শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।
কাশিপুর, বরিশাল
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta