একটি বিকেলের পাথরখনি
অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম, দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার মধ্যপাড়ার পাথরখনিটি পরিদর্শন করতে যাব। ছোট ভাই জহিরুল সেখানে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত রয়েছে। তাই একদিন তাকে ফোন দিলাম। সে আনন্দের সাথে রাজি হয়ে গেল। এইভাবে পাথরখনির ভেতরটা দেখতে পারব, ভাবতেই ভালো লাগলো। আমার সাথে সঙ্গী হলেন আরও তিনজন—সুজাবত ভাই, নিয়ামত ভাই ও সুজারুল ভাই, যারা আমার সহকর্মী। তারা সকলেই খুব খুশি। আমরা চারজনই পার্বতীপুরের খোলাহাটি এলাকার বাসিন্দা।
দিনটি ছিল শনিবার। আমরা দুপুরের খাবারের পর প্রস্তুত হয়ে গেলাম। খোলাহাটি বাজার থেকে আমি এবং নিয়ামত ভাই এক ভ্যানে করে চুতরির মোড়ে গেলাম। ভাড়া ছিল ১০ টাকা করে। পথে সুজারুল ভাই আমাদের সাথে যোগ দিলেন। চুতরির মোড়ে গিয়ে দেখি সুজাবত ভাই নেই। চুতরির মোড়ের সঠিক উচ্চারণ নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে, আমি একে "চৈতির মোড়" বলে থাকি।
একটি রংপুরগামী বাস এলো, আমরা সেই বাসে সওয়ার হয়ে বদরগঞ্জের সিও বাজারে নামলাম। ভাড়া ছিল ১৫ টাকা। সিও বাজার থেকে, আমরা অটোতে চড়ে মধ্যপাড়ার পাথরখনির আবাসিক ভবনের সামনে গিয়ে পৌঁছালাম। ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। জহিরুল আবাসিকেই থাকে। আবাসিকের দুটো গেট রয়েছে এবং আমরা ২ নম্বর গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম।
কিছু সময় পর জহিরুল এলো। প্রথমে আমরা আবাসিক এলাকা পরিদর্শন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিশাল গাছপালায় পূর্ণ এলাকা, একটি খেলার মাঠ, এবং এক কোণে শহীদ মিনার ছিল। একটি বিদ্যালয়ও ছিল, যার দেয়ালগুলো অত্যন্ত সুন্দরভাবে সজ্জিত। এর পাশেই একটি হাসপাতাল ছিল।
এটা বলা হয়নি, স্কুলের সামনের অংশে একটি শিশু পার্ক ছিল, যেখানে অনেক গাছপালা রোপিত। কিছু প্রাণীও দেখা গেল, বিশেষত কাঠবিড়ালি।
আবাসিকের একপাশে ফ্যামিলি কোয়ার্টার রয়েছে, তবে আমরা সেদিকে না গিয়ে, মেইন রাস্তায় পাশে বিশাল পুকুর দেখতে গেলাম। দুইটি ঘাট ছিল এবং একপাশে বিশাল আমড়া গাছ। গাছটি আমড়া দিয়ে ভর্তি ছিল।
এবার আমরা আবাসিকের ১ নম্বর গেট দিয়ে বের হয়ে পাথরখনির দিকে চলে গেলাম। অল্প দূরে একটি ভ্যানে চড়ে প্রধান ফটকের কাছে পৌঁছলাম। জহিরুলের পরিচয়ে আমরা খনির ভেতরে প্রবেশ করলাম। এ অভিজ্ঞতায় এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভব হচ্ছিল। বিশেষ করে নিয়ামত ভাই বেশ খুশি ছিলেন এবং ছবি তোলার জন্য মনোনিবেশ করলেন। গেটের ভেতরের বাম পাশে পাথরের স্তূপ ছিল। আমরা সেগুলো হাতে নিয়ে পরীক্ষা করছিলাম। জহিরুল বলল, এই পাথর অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের। পৃথিবীর সব পাথরই পাহাড় ভেঙে আহৃত হয়, তবে আমাদের দেশের খনি থেকে পাওয়া পাথর বেশি ভালো মানের। এই পাথরের মাধ্যমে দেশের প্রায় ১০ ভাগ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব, আর বাকি চাহিদা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
গেট থেকে দীর্ঘ একটি রাস্তা ধরে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। রাস্তার দু’পাশে দেবদারু গাছের সারি ছিল। স্তূপাকৃত পাথরের দেয়ালে আমরা গ্রুপ ছবি তুললাম। পাথরের বিশাল স্তূপগুলো দেখতে ছোট ছোট টিলার মতো মনে হচ্ছিল। আরো কিছু দূরে গিয়ে আমরা ডানপাশে একটি অফিস পেলাম, যেখানে জহিরুল বসে। অফিসের ওপাশে ছিল খনির মুখ বা কূপ। খনির প্রায় এক হাজার ফুট নিচে শ্রমিকরা কাজ করছিল। লিফটের মাধ্যমে তারা উপরে নিচে যাতায়াত করছিল। শ্রমিকরা সবাই দেশের স্থানীয় মানুষ।
পাথর খনি থেকে বেল্টের মাধ্যমে পাথর উপরে উঠিয়ে আনা হয়। বড় পাথরগুলো ভেঙে ছোট আকারে তৈরি করা হয়, যা পরে দেশের নানা জায়গায় পরিবহন করা হয়।
খনিমুখের কাছে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ। আমরা কেবল আশপাশ ঘুরে দেখতে পেরেছি। বামপাশে বিদেশিদের জন্য আবাসিক ভবন ছিল, যেখানে প্রতিটি রুমে এয়ার কন্ডিশনার ছিল। জানলাম, এখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দা রাশিয়ান।
আমরা আরো সামনে এগিয়ে গেলাম এবং পাথরের স্তূপ দেখে মুগ্ধ হলাম। প্রথমে ছোট পাথরের স্তূপ, তারপর মাঝারি সাইজের এবং সবচেয়ে বড় সাইজের পাথরের স্তূপগুলো ছিল। বিশাল পাথরের স্তূপগুলো বিরাট জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে ছিল। এর পর আর এগোনো সম্ভব ছিল না। গোধূলির ম্লান আলোতে, পাথরের সাথে আকাশের মিতালী ঘটিয়ে আমরা বিদায় নিলাম।
রাজেন্দ্রপুর, গাজীপুর
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta