১০ মাসে ৩ শতাধিক ঘটনার ফলসে নিহত ১৬৩ জন
অনেকের কাছে সেদিন সকালে সূর্যের আলোকচ্ছটা ছিল শুভ, কিন্তু ওই পরিবারের তিন সদস্যের জন্য দিনটি ছিল মর্মান্তিক। কুমিল্লার মুরাদনগরের কড়ইবাড়িতে গত বৃহস্পতিবার সকালে এক মা ও তার ছেলে-মেয়েকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে খলিলুর রহমানের স্ত্রী রোকসানা আক্তার রুবি (৫৫), ছেলে রাসেল মিয়া (৩৮) ও মেয়ে জোনাকী আক্তার (৩২) নির্মমভাবে প্রাণ হারান।
নিহত রাসেল মিয়ার স্ত্রী মীম আক্তার বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা শুনেও বিশ্বাস হয়নি মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে।’ ঘটনার পর কুমিল্লা পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খান বলেন, কেউ অপরাধ করলে তাকে আইনের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া উচিত। অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে। তবে, গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত কাউকে আটক করা হয়নি।
গত রবিবার ভোরে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে গ্রিনল্যান্ড লিমিটেড কারখানায় ১৯ বছর বয়সী শ্রমিক হৃদয়কে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। চুরির অভিযোগে তাকে রশি দিয়ে বেঁধে নির্মমভাবে পেটানো হয়। পুলিশ হত্যা মামলার পর চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। হৃদয় টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার শুকতার বাইদ গ্রামের আবুল কালামের ছেলে এবং কারখানায় মেকানিক্যাল মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন।
হৃদয় কি কখনো ভাবতে পারেনি এভাবেই তার জীবন শেষ হবে?
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘মব সন্ত্রাস’ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সাধারণ মানুষকে অস্থির করে তুলেছে। আক্রান্তরা আতঙ্কে রয়েছেন, অপরাধীরা অধিকাংশ সময় শাস্তিহীন থেকে যায়। রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকারকর্মীরা এই পরিস্থিতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
সরকারের উপদেষ্টারা কয়েক মাস ধরেই মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের সতর্কতা দিয়েছেন। যদিও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু মব সন্ত্রাস কমেনি।
গবেষণা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জুন পর্যন্ত ১০ মাসে ২৫৩টি মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৬৩ জন নিহত ও ৩১২ জন আহত হয়েছেন।
মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) জানায়, গত জুনে দেশের ৪১টি গণপিটুনির ঘটনায় ১০ জন নিহত এবং ৪৭ জন গুরুতর আহত হন। পুলিশে ৩০ জন আহতকে হস্তান্তর করা হয়েছে। এসব গণপিটুনির অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ডাকাতি, চুরি, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কটূক্তি, প্রতারণা ও অপহরণ।
এমএসএফ মনে করে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব অপরাধীদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া, কারণ মব সহিংসতা সমাজে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ৭৮ জন গণপিটুনিতে মারা গেছেন। এছাড়া গত বছরের শেষ চার মাসে ৭৫ জন নিহত হয়েছিল। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি বলছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত মে পর্যন্ত ২০২টি মব সন্ত্রাসের ঘটনায় ১৩১ জন নিহত এবং ১৬৫ জন আহত হয়েছেন।
বৈরবপূর্ণ জনতা যখন নিজ হাতে আইন কার্যকর করে সহিংসতা চালায়, তখন তাকে মব জাস্টিস বা অরাজক জনতা বলা হয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামাজিক অস্থিরতা, আইনের শাসনহীনতা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও অর্থনৈতিক সমস্যা মিলে গণপিটুনির ঘটনা বাড়াচ্ছে।
মব সন্ত্রাস বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষের ওপর হামলা ও গণপিটুনির ঘটনা বেশি ঘটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মব তৈরি করে হামলা করা হয়, এবং কিছু ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও মব গঠন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘মব সন্ত্রাস কমছে না, কারণ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আদেশ দিলেও অপরাধীরা তা উপেক্ষা করছে। রাজনৈতিক পরিচয়ে তৈরি মবের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দল কর্তৃক কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’
পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম শুক্রবার বলেন, ‘মব সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনের শাসন জরুরি। কেউ অপরাধ করেও ছাড় পাবে না। পুলিশের একার পক্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, তাই সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’
তিনি আরো বলেন, ‘পুলিশের কাজে বাধা দেয় এমনদেরও গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।’
গত ছয় দিনে দেশে ছয়জন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ রাজধানীতে মঙ্গলবার গভীর রাতে আল আমীন নামে এক যুবককে ছিনতাই সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মুগদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
গত রবিবার লালমনিরহাটে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে সেলুন কর্মী পরেশ চন্দ্র শীল (৬৯) ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীল (৩৫) কে গণপিটুনি দিয়ে সেলুনে আটকে রাখা হয়।
২২ জুন রাজধানীর উত্তরায় সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদাকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা মারধর ও অমানবিকভাবে নির্যাতন করে। এর পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে মব সৃষ্টির মতো ঘটনা কাম্য নয় এবং তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
৬ মে গুলশানে ভাস্কর রাসাকে হেনস্তা করা হয়, ১৩ মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্যকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়, ২০ মে ধানমণ্ডিতে মব তৈরি করে হাক্কানী পাবলিশার্স মালিকের বাড়িতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা হয়।
সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে গত বুধবার মানসিক প্রতিবন্ধী শামীম হোসেনকে গলা পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানায়, নিহতের মরদেহ ডোবা-জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া গেছে এবং ধারণা করা হচ্ছে, আগুন দিয়ে শরীরের আলামত নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
ডিএমপি সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ‘মব সন্ত্রাস রোধে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
বিএনপি’র কঠোর বার্তা: সম্প্রতি বিএনপির উচ্চ পর্যায় থেকে মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেয়া হয়েছে, যা দলের কর্মী ও সমর্থকদের জন্য একটি বার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দলীয় নেতা কর্মীরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে বিরোধীদের হেনস্তা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেড়েছে, যার বিরুদ্ধে বিএনপি অবস্থান জানিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘মব সন্ত্রাস কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। অপরাধের বিচার আদালতে হবে, রাস্তায় নয়। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। বিএনপি এই অপশক্তির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে, তবে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।’
বাম জোটের সমালোচনা: সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটমান মব সন্ত্রাস ও সহিংসতায় বাম গণতান্ত্রিক জোট গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা সরকারের নীরবতা কঠোরভাবে সমালোচনা করেছে। বিশেষ করে মুরাদনগরের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড এবং নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা দেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
বাম জোটের কেন্দ্রীয় নেতারা রুহিন হোসেন প্রিন্স, মোহাম্মদ শাহ আলম, বজলুর রশিদ ফিরোজ, ইকবাল কবির জাহিদ, মাসুদ রানা, মোশরেফা মিশু ও আব্দুল আলী এক যৌথ বিবৃতিতে এসব ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন।
প্রতিবাদ সমাবেশ: ‘নতুন অপরাধীদের নাম এখন মব সন্ত্রাস। এ নিয়ে দেশের মানুষ ভীত ও আতঙ্কিত।’ গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা এ কথা বলেন। তারা বলেন, সরকারের প্রধান কাজ এখন মব বন্ধ করা, তা না হলে দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
প্রধান বক্তা মুজিব রহমান বলেন, ‘সারা দেশে এখন মব আতঙ্ক বিরাজ করছে। সরকারের দায়িত্ব আইনের শাসন নিশ্চিত করে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া ও বিচার প্রক্রিয়া সহজ করা।’
বিয়ের অনুষ্ঠানে মিছিল: গত রাতে চট্টগ্রামের চিটাগং ক্লাব লিমিটেডে এক আওয়ামী লীগ নেতার ছেলের বিয়েতে একদল লোক মিছিল করে ক্লাবের গেটের সামনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। তারা জানান, ওই নেতা জাহিদুল
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta