বিচার ও সংস্কার কি নির্বাচনের বিরোধী?
ঈদের ছুটি শেষ হয়েছে বেশিরভাগ সময় নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণভাবে। ঈদযাত্রায় সাধারণ মানুষের কোনো বড় ধরনের সমস্যা হয়নি। দীর্ঘ ছুটির কারণে পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে পুনর্মিলন ঘটেছে, যা অনেকদিন পর হয়েছে। এবারের ঈদ কেনাকাটায় সিন্ডিকেটের দাপট ছিল না। বাজারে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। ঈদের সময় আইনশৃঙ্খলার অবস্থা ছিল সন্তোষজনক। সব মিলিয়ে কিছুদিনের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার পর মানুষ কিছুটা স্বস্তি ও আস্থা ফিরে পেয়েছে। তবে এই শান্তি ও স্বস্তির পর নতুন প্রশ্ন উঠে এসেছে মানুষের মনে। মানুষের মধ্যে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। আগামী রাজনীতি কেমন হবে? নির্বাচন এবং সংস্কারের পথে রাজনীতি কি বিভক্ত হয়ে যাবে? দেশে কি নতুন করে অশান্তি তৈরি হবে নির্বাচনের, গণহত্যার বিচার এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে?
বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। তাদের মতে, ন্যূনতম সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন করা উচিত। বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিকল্প নেই। অন্যদিকে তরুণ সমাজ মনে করছে, রাষ্ট্র সংস্কার এবং বিচার আগে হওয়া উচিত, তারপর নির্বাচন। এই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঈদের সময় দ্বন্দ্ব ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঈদের পর এই রাজনৈতিক টানাপোড়েন কি বড় বিরোধে পরিণত হবে এবং তার পরিণতি কী হবে?
৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর বর্তমান সরকারের মেয়াদ প্রায় আট মাস হয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা সামনে আসেনি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার কিছুটা সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। প্রধান উপদেষ্টা বারবার বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে কি গণহত্যার বিচার এবং রাষ্ট্র সংস্কার করা সম্ভব? দুইটি প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি, এবং আগামী জুনের মধ্যে তা শেষ করা কঠিন। যারা জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, তাদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়া চলছে। জুলাই বিপ্লব আমাদের সামনে একটি বাস্তবতা নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। এটি একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে। এর অবসান ঘটানোর জন্য ভারসাম্যপূর্ণ জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এটি শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনা নয়, সংবিধান, বিচার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সকল ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি। কিন্তু এ সংস্কার কিভাবে হবে, কতটুকু সময় নিবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক অঙ্গন বিভক্ত হচ্ছে।
যদি সবার আগে নির্বাচন হয়, তবে কি রাষ্ট্র সংস্কার এবং বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে? এই প্রশ্নটি এখন রাজনৈতিক আলোচনার মূল বিষয়। যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাবো যে, জুলাই আন্দোলন, দুর্নীতি এবং লুণ্ঠনের বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার এবং নির্বাচন তিনটি আলাদা বিষয়। তবে অনেকে মনে করেন যে, নির্বাচন আগে হলে বিচার এবং সংস্কার বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এটি নিয়ে কিছু আশঙ্কা রয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের যে নতুন রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি হওয়া প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। একাত্তরের ঘাতকদের বিচার হয়নি যথাসময়ে। নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানের পর যে পরিকল্পনা হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি। অনেকেই এবার সতর্ক আছেন। যারা বিচার এবং রাষ্ট্র সংস্কার আগে চাচ্ছেন, তাদের যুক্তি হল নির্বাচন হলে বিচার এবং সংস্কার বাধাগ্রস্ত হবে। তবে এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের পরেও নির্বাচনের পর বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি। বরং বিচার প্রক্রিয়া চলেছে এবং এরশাদকে দণ্ডিত করা হয়েছে। কাজেই নির্বাচন হওয়া মানে বিচার বন্ধ হবে এমন কোনো ভিত্তি নেই।
বর্তমান সময়ে, বিচার এবং রাষ্ট্র সংস্কার কখনোই নির্বাচন ও একে অপরের বিরোধী হতে পারে না। বরং, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন বিচার প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্র সংস্কারকে আরও ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করতে পারে। এটি গণতন্ত্রের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রক্রিয়া একটি চলমান বিষয়। এটি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের মতামত জানতে হবে এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জনগণের মতামত প্রকাশিত হবে। সুতরাং, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য একটি নির্বাচন প্রয়োজন, কারণ জনগণই ঠিক করবে কিভাবে রাষ্ট্র সংস্কার হবে।
অদিতি করিম, নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল : ধঁফরঃবশধৎরস@মসধরষ.পড়স
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta