বাবুরাম সাপুড়ে, রাজনীতির ছোবলে!
রাজনীতির ব্যাপারে বাবুদের নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সুকুমার রায়ের জনপ্রিয় শিশুতোষ কবিতা "বাবুরাম সাপুড়ে"র কথা মনে পড়ল। যারা আমার বয়সী, তারা নিশ্চয়ই শৈশবে এই কবিতাটি পড়েছেন। আমি জানি না, তারা এখন কী ভাবছেন, তবে আমার কাছে এই কবিতাটি বিভিন্ন রঙ, বর্ণ এবং গহিন অর্থে বারবার ফিরে আসে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মানবিকতা, দাম্ভিকতা, কাপুরুষতা, কল্পনা, রাজনীতি, এবং অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে আমি কীভাবে এই কবিতার প্রভাবিত হই, সেটি আজ আপনাদের জানাব। তবে তার আগে শিরোনামের দ্বিতীয় অংশটি ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
বাংলা ব্যাকরণে "কাপুড়ে বাবু" একটি পরিচিত বাগধারা, যা মূলত ভণ্ডকে বোঝায়। তবে কাপুড়ে বাবুদের এবং সাধারণ ভণ্ডদের মধ্যে যে বিশাল তফাত রয়েছে, তা খুঁজে বের করতে গিয়ে আমি বিস্মিত হয়েছি। আমাদের চারপাশে এমন অনেক কিছু রয়েছে, যা এখনও বোঝা হয়নি, এবং সেগুলোর মধ্যে কাপুড়ে বাবু বাগধারাটি অন্যতম। পৃথিবীতে দর্শনশাস্ত্র এবং যুক্তিবিদ্যার গুরুত্ব যে সব শাখার চেয়ে বেশি, তা আমি আবারও অনুভব করেছি। কারণ, যদি আমরা চিন্তা না করি, তখন প্রকৃত সত্য কখনোই সামনে আসবে না। "কাপুড়ে বাবু" শব্দটির পরিপ্রেক্ষিতে যদি ভাবনা না হয়, তবে সমস্যা নেই। কিন্তু যদি প্রশ্ন ওঠে, কেন ব্যাকরণবিদরা সরাসরি ভণ্ড শব্দটি ব্যবহার না করে কাপুড়ে বাবু ব্যবহার করেছেন?
দার্শনিকরা বলেন, ভণ্ড একটি সাধারণ এবং প্রচলিত শব্দ। ভণ্ড যদি দুর্বল হয়, তবে সাধারণ মানুষ খুব সহজেই তাকে ভণ্ড বলে দিতে পারে। তবে যদি ভণ্ড একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি হন, তখন তাকে ভণ্ড বলার সাহস কারোই হয় না। সেজন্যই ভাষাবিদরা কাপুড়ে বাবু শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যাতে ক্ষমতাধর ভণ্ডদের অপমান করা যায়।
রাজনীতিতে সবসময় কাপুড়ে বাবুদের প্রভাব ছিল, আছে এবং থাকবে। আমাদের দেশে এই কাপুড়ে বাবুদের নিয়ে আলোচনা করবো, তবে তার আগে সুকুমার রায়ের কবিতাটি এবং রাজনীতির কাপুড়ে বাবুদের মধ্যে কী সম্পর্ক তা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে নীরব চাঁদাবাজি, যা আগে অপ্রকাশিত ছিল, এখন প্রকাশ্যে হচ্ছে, এবং কাপুড়ে বাবুদের নানা আকুতি দেখে কবিতাটি মনে পড়েছে। রাজনীতির কাপুড়ে বাবুদের ভণ্ডামির ফলে জনগণের জানমাল, ইজ্জত বিপদে পড়ছে, এবং কবিতার সাথে এর সম্পর্ক বুঝতে এই ভাবনা জরুরি।
বাবুরাম সাপুড়ে কবিতার নায়ক একটি শিশু। সে সাহসী নয়, কিন্তু কল্পনায় বিভোর। সে সাপ নিয়ে খেলতে চায়, যা আমাদের সংস্কৃতিতে পুরনো একটি ধারণা। বাচ্চারা সাপ খেলা দেখতে পছন্দ করে, এবং অনেকের সাপুড়ে হওয়ার ইচ্ছা থাকে। সাপুড়ের কাছে গিয়ে তারা শিখতে চায়, কীভাবে সাপকে বাঁশি বাজিয়ে নাচানো যায়।
বাচ্চাদের মধ্যে সাপের প্রতি আগ্রহ যেমন থাকে, তেমনই সাপের প্রতি ভয়ও থাকে। অনেকেই সাপ থেকে বাঁচার জন্য তাবিজ পরেন, অথবা দোয়া-দরুদ পড়ে। কবিতায় বালকটি এমন দুটি সাপ চায়, যেগুলোর কোনো চোখ নেই, শিং নেই, কিংবা কামড় দেয় না। এই সাপগুলো শান্তভাবে শুধু দুধভাত খেয়ে চুপচাপ থাকতে চায়। কবিতার শেষাংশে সুকুমার রায় বালকের মুখ দিয়ে এমন একটি বাক্য উচ্চারণ করেছেন যা বাংলার চিরাচরিত স্বভাবকে ফুটিয়ে তোলে।
আপনি যদি বালকের সাপ নিয়ে ধারণা বিশ্লেষণ করেন, তবে আপনি দেখবেন যে বাঙালির আত্মঘাতী মনোভাব, অসংযত আচরণ, দাম্ভিকতা এবং দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করার প্রবণতা এখানেই দেখা যায়। প্রথমত, বালক যে সাপ দুটি চায়, সেগুলো নির্বিষ, তবুও সে কেন সেগুলোকে তাড়া করে মারতে চায়? তার আচরণ তার মনোবৃত্তি এবং অহংকারের পরিচয় দেয়।
এই কবিতার বালকের ইচ্ছা এবং আমাদের দেশের কাপুড়ে বাবুদের চরিত্রের মধ্যে যদি তুলনা করা হয়, তবে দেখা যাবে যে কাপুড়ে বাবুরা কখনোই মহান যোদ্ধা হতে চায় না। তারা শুধুমাত্র নিজের ভোগ-বিলাস, আরাম, এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়, আর এর জন্য তারা শুধুমাত্র মোনাফেকি এবং ভণ্ডামি ব্যবহার করে দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করে সফলতা লাভ করতে চায়।
এখন আমরা রাজনীতির কাপুড়ে বাবুদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি। সারা দেশে কাপুড়ে বাবুদের ক্ষমতা দুর্বল-অসহায় জনগণের উপর চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে অনেক মানুষের জীবন থেমে গেছে, অনেকের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। এ অবস্থায় দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশে এক অদ্ভুত নীরবতা দেখা যাচ্ছে, এবং মাঝে মাঝে অস্থিরতাও লক্ষণীয়। জীবন এবং কর্মের গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, এবং অনেকেই বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta