জাতি ও শ্রেণির ভিত্তিতে বিভক্ত সমাজ।
জাতি ও শ্রেণির বিষয়ে উপমহাদেশ এবং বাংলাদেশে চার ধরনের চিন্তা ও উদ্বেগ দৃশ্যমান। প্রথমটি জাতীয়তাবাদ, দ্বিতীয়টি উদারনীতি, তৃতীয়টি ধর্মীয় মৌলবাদ এবং চতুর্থটি সমাজতন্ত্র। এদের মধ্যে বিভেদ রয়েছে, তবে তা সহজেই দেখা যায় যে প্রথম তিনটি একই ধারার এবং চতুর্থটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাতীয়তাবাদী, উদারনীতি ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা একে অপর থেকে আলাদা, তবে মৌলবাদীরা সবচেয়ে আলাদা, তবুও তিনটি ধারাই পুঁজিবাদে বিশ্বাসী।
পুঁজিবাদের মূল ধারণা হলো ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার। সমাজতন্ত্র বিভিন্ন আকারে হতে পারে, কিন্তু এর কেন্দ্রে রয়েছে ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। তাই সমাজতন্ত্র অন্য তিন ধারার প্রতিপক্ষ এবং শত্রু। অন্যান্যরা শ্রেণিব্যবস্থা বজায় রাখতে চায়, সমাজতন্ত্রীরা তা ভাঙতে চায়।
জাতীয়তাবাদের দুটি প্রধান প্রকাশ রয়েছে—একটি আক্রমণাত্মক এবং অপরটি আত্মরক্ষামূলক। ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশদের জাতীয়তাবাদ ছিল আক্রমণাত্মক, যেখানে মূল লক্ষ্য ছিল লুণ্ঠন; আর ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদ ছিল আত্মরক্ষার, যাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন।
এ পার্থক্য স্পষ্ট, তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে দুই পক্ষই পুঁজিবাদে বিশ্বাসী ছিল। ব্রিটিশরা এসেছিল সম্পদ লুণ্ঠন করতে, আর স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা জাতীয়তাবাদীরা চেয়েছিল সেই সম্পদ দেশেই রাখতে। তবে, সম্পদ সবার সমানভাবে বিতরণ হবে না; শ্রেণিব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ থাকবে, যার মানে হলো ধনী আরও ধনী হবে এবং গরিবরা আরও দরিদ্র হবে।
দেশীয় জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে সশস্ত্র বিপ্লবীদের উপস্থিতি ছিল, যারা অহিংস গান্ধীবাদীদের থেকে মৌলিকভাবে আলাদা ছিলেন। গান্ধী ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্রতায় আস্থাশীল ছিলেন, আর সশস্ত্র বিপ্লবীরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী না হয়ে সনাতন ধর্মের পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাস করতেন।
জওহেরলাল নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন যে তিনি প্রায় কমিউনিস্ট হতে যাচ্ছিলেন, তবে জাতীয়তাবাদী চিন্তা তাকে এ পথে যেতে দেয়নি। তিনি বাপুজির সাথে ছিলেন এবং তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ছিল।
সুভাষচন্দ্র বসু, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে আরও দৃঢ় ছিলেন। তিনি গান্ধীর আপসকামী নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সামরিক পথ অনুসরণ করেছিলেন। তিনি সমাজতন্ত্রের ধারণাও ভাবতেন, তবে তিনি জাতীয়তাবাদী ছিলেন এবং তাই কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেছিলেন।
ব্রিটিশ শাসনকালে, জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল মূলত সমাজ বিপ্লবের সম্ভাবনা ঠেকানোর জন্য। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের ভয়ে, যাতে তারা ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণিকে পাশে টেনে নিতে পারে।
কংগ্রেস সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রচার করলেও, এর মধ্যে শ্রেণিগত বাস্তবতা চাপা পড়ে ছিল। কৃষকরা জমিদারদের দ্বারা শোষিত হচ্ছিল, কিন্তু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি তা আড়াল করেছিল।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস জাতীয় ঐক্যের কথা বললেও, সেই ঐক্যের ভিতরে ধর্মীয় বিভাজন তৈরি হয়। একই সঙ্গে মুসলিম লীগও গঠিত হয় এবং জাতির বিভাজন ঘটে। সমাজতন্ত্রীরা বিপ্লবের পক্ষে থাকলেও, জাতীয়তাবাদীদের প্রভাব অনেক বেশি ছিল।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta