বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা বজায় রেখে সফল সহযোগিতার ভবিষ্যৎ গঠন সম্ভব
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন চীন এবং অন্যান্য দেশের পণ্যের উপর একতরফাভাবে অযৌক্তিক শুল্ক আরোপ করে পূর্বসূরি সরকারের বিভ্রান্তিকর নীতি অব্যাহত রেখেছে। এই পদক্ষেপ সঠিক তথ্যকে বিকৃত করে, সাদা এবং কালোকে একত্রিত করে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও জটিল করে তোলে। এটি একতরফা অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার একটি উদাহরণ। একটি দায়িত্বশীল বিশ্ব শক্তি হিসেবে, চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) এর বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে এবং সুরক্ষাবাদী ও হেনস্তা করার কৌশলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপগুলি আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক নিয়ম ও নীতিমালার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একতরফাভাবে শুল্ক আরোপের মাধ্যমে, যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং বাণিজ্য ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে, বাজারনীতির ধারণা এবং মুক্ত বাণিজ্যের মূলনীতির বিরোধিতা করছে এবং বিশ্বায়নের বিপরীতে অবস্থান নিচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ অজুহাতে একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে রাজনীতি, যন্ত্রণা এবং অর্থনীতি-বাণিজ্যিক বিষয়গুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। এই পদক্ষেপ শুধু ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’ এর বৈষম্যহীন নীতি লঙ্ঘন করে না, বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নতির জন্য সঠিক বাণিজ্যিক পথ বন্ধ করে দেয়।
চীন সবসময় আন্তর্জাতিক নিয়মাবলী ও আদর্শের দৃঢ় সমর্থক এবং সংঘাতের পরিবর্তে আলোচনা ও পরামর্শের মাধ্যমে মতপার্থক্য সমাধানের পক্ষে অবস্থান করে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একমাত্র কার্যকর উপায় হল বহুপাক্ষিকতা, এবং কোনো দেশেরই নিজেকে আন্তর্জাতিক নিয়মের ঊর্ধ্বে অবস্থান করানো উচিত নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী শিল্প এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নকে গুরুতরভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে। শিল্প এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের স্থিতিস্থাপকতা রক্ষা করা বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি সব দেশের যৌথ স্বার্থে কাজ করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি বজায় রাখা, উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। তবে, দুঃখজনকভাবে, কিছু মার্কিন নীতিনির্ধারক ‘শক্তির অবস্থান’ থেকে আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, যা প্রযুক্তিগত বিনিময়ে বাধা সৃষ্টি করে, চীনের শিল্প উন্নয়নকে অবমূল্যায়ন করে এবং ‘অতিরিক্ত ক্ষমতার’ ভিত্তিহীন দাবি করে, সেই সঙ্গে ‘সরবরাহের’ উপর জোর দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর উদ্বেগ এবং তীব্র বিরোধিতার জন্ম দিয়েছে, যা ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’ ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়েছে।
চীন ধারাবাহিকভাবে উন্মুক্ততার নীতিতে বিশ্বাস রেখে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গ্রহণ করেছে এবং মানবজাতির জন্য একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ, আন্তরিক ও পারস্পরিক উপকারিতা ভিত্তিক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে চলেছে। এই নীতি বিশ্বব্যাপী শিল্প ও সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে, নতুন মার্কিন প্রশাসনের কর্মক্রম এই দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে দাঁড়িয়েছে, যা আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এই ধরনের দ্বিমুখী আচরণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতা এবং পারস্পরিক আস্থা গঠনের পক্ষে ক্ষতিকর। একদিকে চীনের সাথে উন্নত সম্পর্ক এবং বাস্তবসম্মত সহযোগিতার দাবি জানালেও, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা পারস্পরিক বিশ্বাসকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে বিপদে ফেলে।
চীন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক একে অপরের পরিপূরক। একপক্ষ সবসময় হারায় এবং অন্যপক্ষ লাভবান হয়, এমন কোন দৃশ্য নেই। তথ্য প্রমাণে স্পষ্ট যে, শুল্কের মাধ্যমে ‘প্রাচীর নির্মাণ’ বাজারের নীতিমালা পরিবর্তন করতে পারে না, এবং এটি সহযোগিতার গতিকে বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম নয়। ২০২৪ সালে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ৬৮৮.২ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে, যা ২০১৭ সালের তুলনায় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন সংস্থাগুলোর অর্ধেকেরও বেশি ২০২৫ সালে চীনে তাদের বিনিয়োগ বাড়ানোর আশা করছে। সহযোগিতাই চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র সঠিক পথ। যদি যুক্তরাষ্ট্র তার ভুল পথে অটল থাকে, তবে চীন সর্বদা যথাযথ প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রস্তুত।
বিশ্ব আজ অস্থিরতা এবং ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের মুখোমুখি, তাই উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে জরুরি সংহতি ও সহযোগিতা অপরিহার্য। চীন এবং বাংলাদেশ, দুইটি দেশই বিশ্বায়নের সুবিধাভোগী ও অবদানকারী, এবং তাদের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে ব্যাপক ঐকমত্য বিদ্যমান। গত বছর, উভয় দেশের নেতৃত্বের পরিচালনায় এবং জনগণের দৃঢ় সমর্থনে, চীন-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জটিল চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও অসাধারণ স্থিতিস্থাপকতা ও শক্তি প্রদর্শন করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধিতে আরও দৃঢ় ভূমিকা রেখেছে।
চীন ও বাংলাদেশ বিজয়ী সহযোগিতা ও মুক্ত বাণিজ্যের আদর্শ উদাহরণ হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ধারাবাহিকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে, যেখানে চীন টানা ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে অবস্থান ধরে রেখেছে। চীনা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চীন-বাংলাদেশ বাণিজ্যের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বেড়েছে। এর পাশাপাশি, চলতি বছরের মে মাস থেকে বাংলাদেশ চীনে আম রপ্তানি শুরু করতে যাচ্ছে, যা দেশের ফল শিল্পের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে এবং দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও ভারসাম্যপূর্ণ করবে।
চীন বাংলাদেশের সঙ্গে বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী রাখতে, একতরফাবাদের বিরোধিতা করতে ও চীন-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনাকে ত্বরান্বিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সহযোগিতায় বাস্তব অগ্রগতি অর্জনে চীন সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
আমি জানি, অনেক বাংলাদেশি চীনে ইলিশসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করতে আগ্রহী। চীন দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির কাঠামোর আওতায় এই প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করবে। আমরা বাংলাদেশের উচ্চমানের পণ্যকে স্বাগত জানাই, এবং চীনের বাজার ক্রমাগত আরও উন্মুক্ত ও সম্প্রসারিত হবে।
চীন এবং বাংলাদেশ শিল্প ও সরবরাহ শৃঙ্খলে সহযোগিতা জোরদার করতে এবং বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ, টেক্সটাইল, গার্মেন্টস এবং সবুজ অর্থনীতির মতো খাতে চীনের অভিজ্ঞতা ও সুবিধা বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশল, শিল্প কাঠামো এবং জনগণের চাহিদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফলে, চীন অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জন্য এক অপরিহার্য অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
চীনের এন্টারপ্রাইজগুলো বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী এবং এখানকার বাজারে তাদের সম্পৃক্ততা আরও গভীর করতে আগ্রহী। চীনা পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশে চীন থেকে সঞ্চিত বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) ৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা চীনকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এফডিআই উৎসে পরিণত করেছে।
২০২৩ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অন্তত ১৪টি চীনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ২৩ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে। এসব বিনিয়োগ মূলত টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, ব্যাগেজ, পাদুকা, উইগসহ বিভিন্ন উৎপাদন খাতে প্রবাহিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সর্বাধিক বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে চীনই শীর্ষে রয়েছে।
২০২৫ সালের বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন আগামী এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। চীন এই সম্মেলনে আরও বেশি ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বকে উৎসাহিত করতে আগ্রহী এবং চীনা কোম্পানিগুলোকে এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হবে। চীন-বাংলাদেশ বিনিয়োগ চুক্তিকে আরও কার্যকর করতে এবং উভয় দেশের উদ্যোগগুলোর জন্য নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ উন্মোচন করতে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে প্রস্তুত। অভিন্ন উন্নয়নের লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে আরও সুসংহত করার মাধ্যমে দুই দেশই অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে।
রাজনৈতিক পারস্পরিক বিশ্বাস এবং পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে চীন ও বাংলাদেশ একসাথে প্রকল্প সহযোগিতায় কাজ করতে পারে। প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হয় রাজনৈতিক বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে, এটি বারবার চীনের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এবং চলমান ও নির্মাণাধীন প্রকল্প অপরিবর্তিত থাকবে, যার মধ্যে ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো কার্যকর হবে। এটি চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের প্রমাণ, যা ব্যাপক জনসমর্থন ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা প্রকাশ করে। চীন ও বাংলাদেশের আন্তঃ-সরকারি সহযোগিতা প্রকল্প সফলভাবে এগিয়ে চলছে এবং বাধাহীনভাবে ত্বরান্বিত হচ্ছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, ডাবল পাইপলাইন প্রকল্প এবং সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং স্থাপন কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট এবং ঢাকা উত্তর সিটিতে ডব্লিউটিই পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পও সফলভাবে শুরু হয়েছে। চাইনিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন প্রকল্প শুরু হতে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta