জাগো মাঠ প্রশাসন, ‘কেন নিরব?’...
সম্প্রতি দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতায় খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, লুণ্ঠন, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধের সংবাদ এত বেশি এসেছে যে একে শুধুমাত্র সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করলে তা অপরাধবিশ্বের প্রতিবেদন মনে হবে। পাঠকরা অবশ্য দেশের এবং বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে পত্রিকা পড়েন, তবে কেউ নিশ্চয়ই জানার জন্য পত্রিকা কেনেন না যে কোথায় শিশু ধর্ষিত হয়েছে, কোন সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের চারজন প্রাণ হারিয়েছেন বা কোন বাবা ছিনতাইকারী দ্বারা সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছেন—এগুলো তো মনভেঙে দেওয়া সংবাদ।
দেশব্যাপী অপরাধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী করছেন।
গত বছরের জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলির সময় পুলিশ বাহিনী যে সংকটের মুখে পড়েছিল, তাতে তাদের মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা মনোবল হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিল। তবে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ এবং পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের দৃঢ়তায় পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নত হয়েছে। একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর মূল চালিকাশক্তি হল তার ‘মোরাল’ বা মনোবল। মনোবলে চিড় ধরলে বাহিনী কার্যকরীভাবে কাজ করতে পারে না।
পূর্ববর্তী সরকার পুলিশ বাহিনীকে নিরীহ জনগণ নিধনে ব্যবহারের ফলে বাহিনীর মনোবল প্রায় শূন্য হয়ে গিয়েছিল। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে।
দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে যেকোনো আলোচনা করার সময়, আমার মতে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল দেশের মাঠ প্রশাসন। দেশ বা সরকারের বর্তমান শাসনব্যবস্থা মূলত প্রায় তিনশো বছর আগে ব্রিটিশদের প্রবর্তিত বিধিব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল।
ব্রিটিশরা মোগল শাসনের কাঠামো অপরিবর্তিত রেখেছিল। দেশ শাসন করতো কেন্দ্রীয় সরকার নিয়োজিত কর্মচারীরা। ব্রিটিশরা যে জেলার কাঠামো রেখে গিয়েছিল, সেগুলো এখনও প্রাথমিকভাবে একই রূপে রয়েছে, শুধু কিছু নাম পরিবর্তন হয়েছে। তখনও মাঠ প্রশাসনের মূল কেন্দ্র ছিল জেলা, এবং এখনও তা রয়ে গেছে। জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, এখন তিনি ডেপুটি কমিশনার বা জেলা প্রশাসক।
ডেপুটি কমিশনারের মূল দায়িত্ব ছিল ভূমি প্রশাসন, ভূমি রাজস্ব আদায়, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমন্বয়। সে হিসেবে তিনি সরকারের প্রতিনিধি। তাঁর বক্তব্যই সরকারিভাবে বিবেচিত হয়, বিশেষত আইনশৃঙ্খলা বা রাজনৈতিক বিষয়ে।
পাকিস্তানি শাসনকালে ষাটের দশকে আমার অভিজ্ঞতার আলোকে, মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কিছু মন্তব্য করছি। মাগুরার ধর্ষণের ঘটনা এবং এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভ খুবই স্বাভাবিক। বিশেষত তরুণ ছাত্ররা জাতির বিবেক হিসেবে বারবার তাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছে, যা আমাকে আশাবাদী করে তোলে। তবে আন্দোলনকারীদের মনে রাখতে হবে যে, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা এবং অপরাধ প্রতিরোধের দায়িত্ব মূলত মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের। তাই ঢাকার মন্ত্রীদের পদত্যাগ দাবি করা যুক্তিসঙ্গত নয়, তবে তাদের কাছ থেকে দাবি জানানো যেতে পারে।
এখন মাঠ প্রশাসনের কার্যক্রমে কিছু মৌলিক বিষয় উল্লেখ করা যাক। একটি এলাকার অপরাধী চক্র, চোর, ধর্ষক, ইভ টিজাররা সব সময় পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে। যদি তারা দেখে যে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে সহযোগিতা নেই বা তারা নিজেদের কাজে ব্যস্ত, তবে অপরাধীরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
ডেপুটি কমিশনার এবং সুপারের সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা না করেন, তবে সমস্যার সমাধান কঠিন হয়ে পড়ে। একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে বাস্তবায়ন সহজ হয়। একই কথা ইউএনও এবং ওসি-র ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আরেকটি বিষয় হলো ডি.সি. ও এস.পি.-র জনসংযোগ। জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা ছাড়া তারা সফল হতে পারবেন না। জনপ্রতিনিধিরা স্থানীয় এলাকার সমস্যা সম্পর্কে জানেন এবং তাদের সহযোগিতা ছাড়া জনসমর্থন লাভ করা কঠিন।
একটি ভালো উদাহরণ হিসাবে, ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়ায় আমি ডি.সি. হিসেবে যোগদান করার পর, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আসলে রাজনৈতিক নেতাদের সাহায্য অনেক কাজে এসেছিল। দুই-তিন মাসের মধ্যে সন্ত্রাসের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছিল।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সততা। ডি.সি. এবং এস.পি.-দের সকল কাজে সততা প্রদর্শন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সততার মাধ্যমে জনসমর্থন অর্জন করা সম্ভব।
শেষ কথায়, একটি আবেদন। ডি.সি. এবং এস.পি. কি এখনকার পরিস্থিতিতে, জুলাই-আগস্টের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, মাঠ প্রশাসনকে জনগণের জন্য কার্যকর করতে পারবেন না? তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে অপরাধের প্রতিরোধ সম্ভব, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta