সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার বিষয় নিয়ে
যদি আমরা দারিদ্র্য খুঁজে দেখি, তা সহজেই পাওয়া যায়, এবং অসাম্যও তেমনি। আমাদের সংস্কৃতিতে এই দুই উপাদান কোনোভাবেই অনুপস্থিত নয়। দারিদ্র্য ও অসাম্য একে অপরের খুব কাছাকাছি, এবং বললে ভুল হবে না যে, অসাম্য আসলে দারিদ্র্যের প্রধান কারণ।
অসাম্য যে বিভাজন তৈরি করেছে ধনী-দরিদ্র, শহর-গ্রাম, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মধ্যে, সেটি দারিদ্র্য সৃষ্টি করছে—অর্থনীতি বা সংস্কৃতির মূল কাঠামো থেকে শুরু করে তার ওপরকাঠামো পর্যন্ত। অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের জন্য সাংস্কৃতিক দারিদ্র্যের পথ বন্ধ হওয়ার কোনো বাধা নেই। তবে এটি সত্যি যে, শুধু অর্থ থাকলেই সংস্কৃতির উৎকর্ষ আসবে না, মধ্যপ্রাচ্যের তেল-ধনী কিছু দেশ তার বিপরীতে কথা বলছে। আমাদের আশপাশেই এমন কিছু ধনী পরিবার আছে, যারা যত বেশি ধনী হয়েছে, তত কম তাদের হৃদয়ে মানবিকতা বেড়েছে।
হ্যাঁ, টাকা থাকলেই রুচি আসে না, কিন্তু বিপরীতটা সত্য—টাকা না থাকলে রুচি থাকতে পারে না, কিছুই থাকে না। মানুষ খেতে না পারলে বাঁচে না, যদিও খাওয়া কেবল জীবনযাপনের এক অঙ্গ।
এখানে অবশ্যই একটি বিষয় স্পষ্ট করা উচিত—আমরা সংস্কৃতি বলতে খুব সংকীর্ণ অর্থে চিন্তা করছি না। সংস্কৃতির মধ্যে আমরা শুধুমাত্র সুকুমার শিল্পকলা বুঝাচ্ছি না, বরং এটি চিন্তা ও চেতনার প্রকাশও, যেখানে থাকবে ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিক্ষা এবং জ্ঞানচর্চা।
প্রকৃতপক্ষে, সংস্কৃতি হলো পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটি প্রয়াস, যার মধ্যে আনন্দও রয়েছে, বেদনা রয়েছে। এই প্রয়াসের মাধ্যমে মানুষের চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে, এবং পরিবেশ ও প্রকৃতি যেমন বদলায়, মানুষও পরিবর্তিত হয়।
যদি আমরা সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আলাদা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করি, তবে দেখতে পাবো দারিদ্র্য এবং অসাম্য নানা ধরনের উপায়ে একে অপরকে প্রভাবিত করছে।
এই আলোচনা মূলত একটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, আর কিছু নয়। যদি আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে এটা শুধুমাত্র এই কারণে যে এটি কোনো গোপন বিষয় নয়, এর মধ্যে কোনো ধরনের অন্ধকার নেই। সত্য সোজাসুজি এবং বাস্তব, এর কার্যকারিতা ও সর্বব্যাপী প্রভাব।
২.
এই অঞ্চলে ভাষা সবসময়ই একটি বড় সমস্যা ছিল। এর একটি প্রধান কারণ হলো অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত। অশিক্ষিতদের ভাষা নেই, তাদের কণ্ঠে শুধু আর্তনাদ কিংবা কখনো কখনো এক ধরনের চিৎকার শোনা যায়। তবে শিক্ষিতদের মধ্যেও ভাষার সমস্যা অনেক সময় খেয়াল করা যায়, যে ভাষা হয়তো খুবই অদ্ভুত এবং কুৎসিত। বাংলা কখনোই রাষ্ট্রভাষা ছিল না। শাসক শ্রেণি সংস্কৃত, ফার্সি, ইংরেজি এবং কখনো কখনো উর্দু ব্যবহার করেছে। যদিও ইংরেজির ব্যাপক প্রভাব ছিল, স্বাধীনতার পরেও ইংরেজির ব্যবহার কমেনি বরং বেড়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে, দেশী ঋণ, অনুদান, সাহায্য—সবকিছুই বিদেশ থেকে আসে। সমাজে যারা বেশি বিদেশি প্রভাব ধারণ করে, তারা তত বেশি সম্মানিত। তাই বাংলা ভাষার ব্যবহার কেন চলবে? সমাজের শীর্ষ শ্রেণি বাংলা চর্চা করে না।
আজকাল আমরা দেখি, বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক উঠছে—বাঙালির মাতৃভাষা কি বাংলা, নাকি ইংরেজি? উচ্চশিক্ষিত অনেক বাঙালিই বাংলা ব্যবহার করতে অনাগ্রহী। এমনকি যারা বাংলা ব্যবহার করেন, তাদের বাক্যে ইংরেজি শব্দের আধিক্য বেড়েই চলেছে। এই শ্রেণি সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, তারা ইংরেজি ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে।
বাংলা ভাষার গুরুত্ব যদি সত্যিই দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ হয়, তাহলে দেশের কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এই সাধারণ মানুষের জীবনে কি সত্যি কোনো ভাষা আছে? তাদের জীবনের রূঢ়তা এমন যে, ভাষা এক ধরনের বিলাসিতা মনে হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষই ভাষা রক্ষা করছে, যেমন মা তার সন্তানকে রক্ষা করে।
বাংলার ব্যবহার উচ্চবিত্তদের কাছে কম, যাদের জীবনে বিদেশি প্রভাব বেশি। তবে মধ্যবিত্তরা কিছুটা বাংলা ব্যবহার করেন, কিন্তু তাদেরও অসন্তোষ রয়েছে—তারা কখনো উচ্চবিত্ত থেকে দূরে, কখনো নিম্নবিত্তদের কাছে কাছে থাকে।
আমরা প্রায়ই বলি, বাংলা চলছেনা—অথবা অফিস-আদালতে, উচ্চশিক্ষায় বাংলা ব্যবহার হচ্ছে না। কিন্তু এমনকি বাংলা ভাষায় সব কিছু চালু করা সম্ভব না হলে, উচ্চশিক্ষা তো আরো দূরের বিষয়। এর মূল কারণ, টাকা আসে বিদেশ থেকে এবং ভাষাও বিদেশ থেকেই আসে। বাংলা ভাষা কখনো অফিস-আদালতে এবং উচ্চশিক্ষায় প্রচলিত হবে না, যদি না ব্যাপক সামাজিক বিপ্লব ঘটে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta