ভারতের সম্প্রসারণবাদী পররাষ্ট্রনীতি
ভারত উপমহাদেশ কখনো একক রাষ্ট্র কাঠামো হিসেবে গড়ে ওঠেনি। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রাজ্য ও সাম্রাজ্য গঠিত হয়েছে এবং বিজয়ের মাধ্যমে মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের সময় ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে এক হাজারের বেশি প্রিন্সলি রাজ্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে ছিল। এরপর ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তাই ভারতের বিভক্তি নয়, বরং এটি ছিল সময়ের সাথে সাম্রাজ্যগুলোর পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা।
দুই শতকের বেশি সময় ব্রিটিশ রাজত্ব শেষে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। এর আগেই ব্রিটিশরা পর্যায়ক্রমে সাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। ১৯৩৫ সালের ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’-এ বলা হয়েছিল যে, দেশীয় রাজ্যগুলোর স্বায়ত্তশাসন রক্ষা করা হবে এবং তাদের সম্মতি ছাড়া কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। ১৯৪৭ সালের ১৬ জুলাই ব্রিটিশ সরকার স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিল যে, দেশীয় রাজ্যগুলো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে তারা ভারত, পাকিস্তান বা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে কি না। কিন্তু ভারত সরকার এই নীতিকে উপেক্ষা করে হায়দরাবাদ, জম্মু-কাশ্মির এবং সিকিমসহ বিভিন্ন রাজ্যকে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সাথে সাথে হায়দরাবাদ স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়। এটি ছিল ৮২,৬৯৮ বর্গমাইল আয়তনের একটি সমৃদ্ধ রাজ্য, যেখানে নিজাম ছিলেন বিশ্বের অন্যতম ধনী শাসক। কিন্তু ভারত হায়দরাবাদের স্বাধীনতা মেনে নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী নেহরু একাধিকবার সেনা অভিযান চালানোর হুমকি দেন। ১৯৪৮ সালে সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে ভারত হায়দরাবাদ দখল করে, এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট চালায়। একইভাবে জুনাগড়, মানভাদর ও গোয়ার মতো রাজ্যগুলোও ভারতীয় দখলের শিকার হয়।
কাশ্মির সংকট ছিল সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। কাশ্মির ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা, যা স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। তবে রাজা হরিসিং স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু নেহরু কাশ্মিরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে মরিয়া ছিলেন, কারণ এটি ছিল তার পৈতৃক এলাকা। ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেনও অনুমান করেছিলেন যে, গণভোট হলে কাশ্মির পাকিস্তানে যোগ দেবে। কিন্তু ভারত কৌশলে রাজাকে চাপে ফেলে কাশ্মিরের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে। সামরিক শক্তির মাধ্যমে ভারত কাশ্মির দখল নেয় এবং গণভোটের প্রতিশ্রুতি উপেক্ষা করে সেখানে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করে। বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপিত হলেও ভারত গণভোটের সিদ্ধান্ত মানেনি।
এছাড়াও, সিকিমকে দখল করতেও ভারত ষড়যন্ত্র শুরু করে। ভারত-সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে সেখানে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়, যা রাজার শাসন দুর্বল করে। ১৯৭৫ সালে সিকিম পার্লামেন্ট ভারতভুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়, এবং ভারত সরকার সিকিমকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের রাজ্যে পরিণত করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সহায়তা ছিল কৌশলগত। ভারতের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানকে বিভক্ত করা। কংগ্রেস নেতা বল্লভ ভাই প্যাটেল পূর্ববাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে না দেওয়ার পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে নতুন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করেছিল।
শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহেও ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে, নেপালেও ভারতের আধিপত্য নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ক্ষোভ জমেছে। বাংলাদেশের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক নানা জটিলতায় ভরা, মালদ্বীপের সাথেও সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। পাকিস্তানের সাথে ভারতের বিরোধ তো সর্বজনবিদিত।
উপরোক্ত ঘটনাগুলো দেখায় যে, ভারত ১৯৪৭ সাল থেকে আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে। এর মূল লক্ষ্য হলো বৃহত্তর ভারতের সম্প্রসারণবাদী স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। স্বাধীন ভারতের পররাষ্ট্রনীতি গঠনে নেহরু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন ভারত একদিন প্রশান্ত মহাসাগর থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের নীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়, যেখানে প্রতিবেশীদের শত্রু হিসেবে দেখা হয়।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতারা বরাবরই হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিজেপি শাসনামলে এই নীতি আরও চরম রূপ ধারণ করেছে। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বারবার এই আধিপত্যবাদী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে। তারা কাশ্মির, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদী নীতি বাস্তবায়ন করেছে। তবে বাংলাদেশকে তারা সিকিমের মতো দখল করতে পারবে না। বাংলাদেশের জনগণ এই কূটচাল প্রতিহত করতে প্রস্তুত রয়েছে।
লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
[email protected]
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta