নিয়মনির্ভর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার শেষপরিণতি
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ট্রাম্প প্রশাসনের নিরাপত্তার জন্য ব্যয়ের কঠোর বার্তা দেওয়ার ফলে ইউরোপীয় নেতারা নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার শেষ পর্যায়ের ইঙ্গিত পেয়েছেন। ভাইস প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন, বিংশ শতাব্দীর পরিস্থিতি আর ফিরে আসবে না। মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স গণতন্ত্র রক্ষায় ইউরোপীয় দেশ ও ইইউ কর্মকর্তাদের ভণ্ডামি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন।
তার বক্তব্য আমেরিকার রাইট গ্রুপ এবং ইউরোপের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকারীদের কাছে সমাদৃত হয়েছে, তবে সম্মেলনের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শীতল প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ধীরে ধীরে ইউরোপীয়দের উপলব্ধি হয় যে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রশাসন আগের চেয়ে অনেক ভিন্ন হবে।
তবে, সেই উপলব্ধি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরে সম্মেলনে রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম ও রজার উইকার ভিন্ন মত পোষণ করেন।
প্রভাবশালী উইকার ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ কার্যকর না হওয়ায় প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথকে দায়ী করেন। অন্যদিকে, গ্রাহাম বলেন, ‘ট্রাম্প এখন ইউক্রেনকে ভিন্নভাবে দেখেন’।
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের ফাঁস হওয়া এক বক্তব্যে বলা হয়, ‘এই দেশটির বিশাল সম্পদ রয়েছে... আমি তাকে মানচিত্র দেখালাম।’ যার অর্থ হচ্ছে, নিরাপত্তা বিনিময়ে ইউক্রেনকে তাদের সম্পদের অংশ দিতে হতে পারে।
তবে বাস্তবতা হলো, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে পরিস্থিতি আগের তুলনায় স্পষ্টতই আলাদা। প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনে মাইক পেন্স ছিলেন, যিনি ট্রাম্পের নীতিকে নরম করে উপস্থাপন করতেন। কিন্তু বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ইরাক যুদ্ধকে ভুল হিসেবে দেখেন এবং ইউরোপের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
পেন্স, উইকার ও গ্রাহামের মতো অনেকে রিপাবলিকানদের পুরনো অবস্থানকে প্রতিনিধিত্ব করেন, আর ভ্যান্স ভবিষ্যতের প্রতিচিত্র। তবে, ট্রাম্প যা করছেন তা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।
পিস্টোরিয়াস? তিনি দৃঢ় নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০২০ সালে তিনি ট্রাম্পের সৈন্য প্রত্যাহার পরিকল্পনাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলেছিলেন, কিন্তু বর্তমানে তার দল জার্মানির রাজনীতিতে তৃতীয় অবস্থানে নেমে গেছে।
গ্রাহামের ‘সোনার খনি’ মন্তব্য ইউক্রেনের সম্পদের দিকে ইঙ্গিত করে, যা ট্রাম্প প্রশাসন সামরিক সহায়তার বিনিময়ে দাবি করার কথা ভাবছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এ প্রস্তাবে আপত্তি জানালেও তিনি কী করবেন তা এখনো অনিশ্চিত।
অনেক ইউরোপীয় কর্মকর্তা এতে অসন্তুষ্ট। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের চেয়ার ক্রিস্টোফার হিউসগেন বিদায়ী বক্তব্যের সময় আবেগাপ্লুত হন। ইউরোপীয় মিডিয়া একে ‘ইউরোপের কান্না’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
তিনি পূর্বে বলেছিলেন, ‘পশ্চিম’ শব্দটি বাদ দিয়েছেন কারণ এটি রাশিয়া ও চীন নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করে। তিনি বিশ্বাস করেন, বিশ্ব এখন নিয়মভিত্তিক আদেশ মেনে চলা ও না চলার মধ্যে বিভক্ত।
তবে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার সাথে আর খাপ খাচ্ছে না।
এ অবস্থায় ইউরোপ কি নিরাপদ? ন্যাটো নিরাপত্তা প্রত্যাহার করলে ইউরোপ কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। ট্রাম্প ইউক্রেনের মতো ইউরোপকেও নিরাপত্তার বিনিময়ে অর্থ দিতে বাধ্য করতে পারেন, তবে সেই পরিমাণ এখনো অস্পষ্ট।
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন ইউরোপকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। মার্কিন-ইউরোপীয় সম্পর্ক টালমাটাল হয়ে পড়েছে। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ব্যবস্থার পতনও ঘটতে পারে।
ট্রাম্পের নীতির ফলে রাশিয়া সুবিধা পাচ্ছে। ইউক্রেনে পুতিনের বিজয় পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব আরও বাড়াবে। ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
শুধু ইউরোপ নয়, মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকেও নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব কমতে পারে। রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন ঠেকানোর কাঠামো দুর্বল হতে পারে।
বিশ্ব হয়তো এমন এক যুগে প্রবেশ করছে যেখানে ক্ষমতাধর দেশগুলোই সব সিদ্ধান্ত নেবে।
‘ইউরোপীয় অহংকার’ ইউরোপকে সংকটের মুখে ফেলেছে। এখন তাদের নিজেদের নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে।
নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার অবসান ঘটছে, আর ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপ তা আরও স্পষ্ট করে তুলছে।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta