সরকারি শ্রমের অবৈধ ও অস্বচ্ছ ব্যবহার
সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে মোট চার ধরনের কর্মচারী নিয়োগপ্রাপ্ত রয়েছে। এগুলি হল প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের কর্মকর্তার মর্যাদা দেওয়া হয়, আর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সাধারণ কর্মচারী হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তারা সাধারণত তাদের অফিসে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সহায়তা নিয়ে কাজ করেন। একজন কর্মকর্তা তার কাজের গুরুত্ব অনুসারে সাধারণত এক থেকে পাঁচজন তৃতীয় শ্রেণীর এবং এক থেকে তিনজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর সহায়তা গ্রহণ করেন।
প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা অফিসের কাজে গাড়ির সুবিধা পান, তাদের অধীনে একটি চতুর্থ শ্রেণীর গাড়িচালক নিযুক্ত থাকে। এছাড়া, প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা তাদের অফিসে এমএলএসএস হিসেবে দু’জন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ব্যবহার করে থাকেন, যারা অতিথিদের চা-পান পরিবেশন থেকে শুরু করে কর্মকর্তার খাবার পরিবেশন ও পরবর্তী ধোয়ামোছার কাজও করেন। অফিস সহায়করা কর্মকর্তা ও তার অফিসের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি খাবার পরিবেশন করেন।
সরকারি অফিসগুলোর বিভিন্ন শাখায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের সহায়তায় এক বা একাধিক অফিস সহায়ক নিয়োগ দেয়া হয়। এই অফিস সহায়করা শাখার দাফতরিক কাজের পাশাপাশি অফিস কর্মীদের চা, পান এবং অন্যান্য খাবার পরিবেশনেও সহায়তা করেন।
সরকারি অফিসের গাড়িচালক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী (সুইপার/ঝাড়ুদার), নিরাপত্তাকর্মী (নৈশপ্রহরী) এবং মালী—এ সকল পদের কর্মচারীরা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী।
রাজধানী, বিভাগীয় বা জেলা পর্যায়ে কিছু কর্মকর্তা রয়েছেন যাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ বাংলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই বাংলোগুলোর মধ্যে কিছু কর্মকর্তার জন্য তাদের পরিবারসহ বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। কিছু কর্মকর্তার বাসভবনে বাগানে কাজ করতে মালী নিয়োজিত থাকে।
অফিস সহায়ক হিসেবে যারা নিয়োজিত তাদের কাজের মধ্যে, যদিও ব্যক্তিগত কাজ নিয়মতান্ত্রিক নয়, তবে তাদের কিছু ব্যক্তিগত কাজ করতে হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাজার করা, সন্তানদের স্কুলে আনা-নেয়া, কাপড় ইস্ত্রি করা ইত্যাদি।
অফিস সহায়ক হিসেবে নিয়োগ পেতে যা ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা রাখা হয়েছে তা হলো মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষা পাশ। আগে এটি ছিল অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। অতীতে যারা মাধ্যমিক অথবা তার চেয়ে উচ্চতর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, তারা অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরি পেয়েছেন এবং বর্তমানে অনেক স্নাতক ডিগ্রিধারী অফিস সহায়ক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এসব পদে যোগদানের পিছনে চাকরির অভাব অন্যতম কারণ।
অফিস সহায়কদের মাধ্যমে বেআইনি এবং অনৈতিক সুবিধা নেয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন অবিচল যে তারা নিজ খামারবাড়িতে সরকারি দফতরের অফিস সহায়কদের কৃষিকাজ এবং গরু-ছাগল পালন করিয়ে তাদের বেতনভাতা মাসান্তে তুলে নেন। এই ঘটনার একটি চাঞ্চল্যকর কাহিনী সম্প্রতি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে। এতে এক কর্মকর্তা তার দফতরের কর্মচারীদের দিয়ে খামারে কাজ করাচ্ছেন বলে উঠে এসেছে।
ডক্টরেট ডিগ্রি ধারণকারী একজন কর্মকর্তা, যার উচিত নৈতিকতা এবং নীতিজ্ঞান বজায় রাখা, এমন অনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত হয়েছেন। এরূপ ঘটনা সরকারের জন্য অমঙ্গলজনক এবং তা যে কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত।
অনেক ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা তাদের গৃহে অফিস সহায়কদের দিয়ে গৃহস্থালির কাজ করিয়ে থাকেন। এমনকি বেতনভাতা নিয়ে অফিস সহায়করা যখন কর্মস্থলে যান, তখন পুনরায় তারা এসব কাজ করার জন্য পাঠানো হয়।
সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বিভিন্ন খামারবাড়ি থাকে, যেখানে কৃষিকাজসহ গরু-ছাগল পালন ও অন্যান্য ব্যক্তিগত কাজ হয়। এসব খামারে কাজ করতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা নিয়মিত নিয়োজিত থাকেন, যা দফতরের কাজের সাথে সম্পর্কহীন।
বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচারিত ঘটনা দেশের জনগণকে সচেতন করেছে এবং এমন আরো বহু ঘটনা রয়েছে যা সরকারী দপ্তরের অধস্তনরা জানলেও দেশের জনগণ জানে না। যারা এই অনৈতিক কাজের খবর জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তাদের ধন্যবাদ জানানো উচিত।
পদস্থ কর্মকর্তাদের দ্বারা এই ধরনের বেআইনি কার্যক্রম সরকারকে বিশাল ক্ষতি করতে পারে। যেসব কর্মকর্তারা এমন কাজ করছেন, তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার চলতে থাকলে সরকারি দপ্তরের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে না।
বিশ্বের উন্নত দেশে এমন কাজের নজির নেই, যেখানে অফিস সহায়কদের ব্যক্তিগত কাজ করানোর সুযোগ থাকে। যদি আমরা একটি উন্নত দেশ গড়তে চাই, তবে আমাদের কর্মকর্তাদের এই ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta