গ্যাস সংকট: সাগরে অনুসন্ধান বাড়ানো জরুরি
গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট ক্রমশ আরও তীব্র হচ্ছে। ঢাকার সাভার, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং নরসিংদীর শিল্প-কারখানাগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ না পাওয়ায় উৎপাদন ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এর ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম আবারও বাড়ানো হয়েছে, যা শিল্প খাতে বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিল্প ব্যবহারকারীদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের বিল ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করা হয়েছে এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র) গ্যাসের দাম ৩১.৫০ টাকা থেকে ৪২ টাকা করা হয়েছে। পুরনো শিল্প-কারখানায় অনুমোদিত লোডের অতিরিক্ত ব্যবহারে বাড়তি মূল্য দিতে হবে।
জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাজারের অস্থিতিশীলতা, উচ্চ সুদের হার, ঋণপত্রের অভাব, কাঁচামালের সংকট, শ্রমিক অসন্তোষ এবং উৎপাদনের ঘাটতির কারণে দুই শতাধিক কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো চলমান রয়েছে, সেগুলোও অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানো শিল্প খাতকে আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকার দাম বাড়ালেও গ্যাস সরবরাহ তেমন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে না, কারণ দেশীয় কূপগুলোর উৎপাদন কমছে এবং এলএনজি আমদানির সীমা এক হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত।
নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ না করা হলে আমদানি বাড়ানো সম্ভব হবে না। আগামী দুই বছরে নতুন টার্মিনাল চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ বর্তমান সরকারের অধীনে দুটি চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট, অথচ গত রবিবার সরবরাহ করা হয়েছে ২ হাজার ৬৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট, যার ফলে প্রায় দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরবরাহ করা হয়েছে ১ হাজার ৮৭৩ মিলিয়ন ঘনফুট, এবং এলএনজি থেকে ৮২২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। গ্যাস সংকট এখনও কমেনি, বরং আরও বেড়েছে, বিশেষ করে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করেও সংকট পূর্ণভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের ভুল নীতির কারণে দেশ এখন এই সংকটের মুখোমুখি। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হলেও সেগুলোর থেকে উপকার পাওয়া যাচ্ছে না।
ভোলার গ্যাস আপাতত সমাধান করতে পারছে না, কারণ পাইপলাইন না থাকার কারণে সেখানে গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব নয়। সিলিন্ডারে সিএনজি আকারে কিছু গ্যাস অন্যত্র নেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও তার পরিমাণ খুবই কম।
বর্তমানে দেশে মোট ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, যার মধ্যে ১৯টি থেকে গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। প্রতিবছর এক টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, এসব গ্যাসক্ষেত্রে মোট মজুদ ছিল ৩০.৮৩ টিসিএফ।
১৯৬৫ সালে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে এখন পর্যন্ত ১৯.৯৪ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে এবং বর্তমানে মজুদ রয়েছে ৮.৬৮ টিসিএফ গ্যাস। বিদ্যুৎ, সার কারখানা, আবাসিক ও পরিবহন খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের কারণে এই মজুদও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, নতুন বড় মজুদ না পেলে আগামী ৮-১০ বছরের মধ্যে দেশে গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে যাবে।
বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট, যার মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে দেশীয় উৎপাদন প্রতিদিন ২৩০ কোটি ঘনফুট, বাকিটা এলএনজি দিয়ে পূর্ণ হচ্ছে। কিন্তু পুরনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে, অথচ চাহিদা ২০ বছর আগের তুলনায় তিন গুণ বেড়ে গেছে।
দেশে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন খাত এবং শিল্প খাতের পরিমাণ বেড়েছে। ২০০১ সাল থেকে দেশে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেছে। বিইআরসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জ্বালানি খাতের প্রায় ৪৬ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করা হয়। গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেলে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর পরিবর্তে বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি করা হয়, কারণ তখন গ্যাস খনন বা উৎপাদন কম লাভজনক মনে করা হয়েছিল।
বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির মধ্যে এক্সনমবিল, শেভরন, পেট্রোনাস, টিজিএস, স্লামবার্জার, ইনপেক্স, সিনুক, ইনি এসপিএ, ক্রিস এনার্জি, ওএনজিসি বিভিন্ন সময়ে পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এখন নতুন প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান কাজ শীঘ্রই শুরু হতে পারে। তবে, সমুদ্র অনুসন্ধান শুরু হতে আরও কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।
বঙ্গোপসাগরে ২৬টি ব্লক রয়েছে, যার মধ্যে কিছু ব্লকে কাজ চলছে, তবে গত কয়েক বছরে পর্যাপ্ত কাজ হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের গ্যাস সংকট সমাধানে সমুদ্রে অনুসন্ধান বাড়ানোর পাশাপাশি উত্তোলন প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করতে হবে।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta