যুক্তরাষ্ট্র কি ট্রাম্পের সামনে পরাজিত হবে
এই নিবন্ধটি যখন প্রকাশিত হচ্ছে, তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ৮৯তম দিন। গত ২০ জানুয়ারি তিনি প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নিয়েছেন। অর্থাৎ এখনও তাঁর ১০০ দিন পূর্ণ হয়নি। গত ২ এপ্রিল, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে আবার বিশ্ব নেতৃত্বে ফিরিয়ে আনতে এবং চলমান অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে মুক্ত করতে বিভিন্ন দেশের ওপর বাড়তি রপ্তানি কর বসানোর ঘোষণা দেন। তাঁর মতে, চীন ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে অন্যায়ভাবে সুবিধা নিয়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই তিনি এই অনিয়ম বন্ধে পদক্ষেপ নিতে অঙ্গীকার করেন এবং তা বাস্তবায়নে এগিয়ে যান।
চীনের ওপর আগে যুক্তরাষ্ট্র যে কর বসিয়েছিল, তার হার ছিল ৮৪ শতাংশ। ট্রাম্প প্রথমে তা বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ এবং পরে তা আরও বাড়িয়ে ২৪৫ শতাংশ করেন। এরপর ভারত ও বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের ওপরও তাঁর নির্বাহী আদেশে নতুন বর্ধিত শুল্ক আরোপ করা হয়। ৯ এপ্রিল কার্যকর হওয়া এই শুল্কনীতি অনুযায়ী প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রে দুই বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আসার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবে তার উল্টোটা ঘটে। বাজারে হঠাৎ পরিবর্তনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে তিন দিনের মধ্যেই ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। ফলে ট্রাম্প ৯০ দিনের জন্য তাঁর শুল্কনীতি স্থগিত করেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ রিচার্ড ওলফ বলেন, এই বাণিজ্যযুদ্ধ দেশটিকে দ্রুত অর্থনৈতিক মন্দায় ঠেলে দেবে।
পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হয়। নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ্রি স্যাকস মনে করেন, এই নীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে, যদিও চীনের ওপর এর প্রভাব অতটা পড়বে না। তবে বৈশ্বিক বাজারব্যবস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্যাকস দীর্ঘদিন হোয়াইট হাউস, বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি মনে করেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত ও মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই দায়ী।
জেফ্রি স্যাকসের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও রাজনৈতিক কৌশল বিশ্বে নতুন শক্তির উত্থানকে ত্বরান্বিত করবে, বিশেষ করে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোকে। আগামী এক দশকে চীন শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামরিক শক্তিতেও যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। একইভাবে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে ভারতের অর্থনীতিও ২০৫০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। আর যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের উসকানিতে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ায়, তবে উভয় দেশকেই অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনায় পড়তে হতে পারে।
চীনের জন্য এই পরিস্থিতি নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। তারা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে জোট গড়ে তুলছে এবং আসিয়ানের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর আওতায় চীন আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছে। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের শুল্কনীতি চীনকে দুর্বল করতে পারবে না। চীনের এক মুখপাত্র বলেন, "আমরা অতীতেও টিকে ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকব।"
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশ এখন চীনের সঙ্গে শিল্প ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিচ্ছে। চীন ইতোমধ্যে ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার ঘোষণা দিয়েছে, যা দ্রুত লেনদেনের সুবিধা দেবে। ইউরো ও রুবলের মতো মুদ্রাও বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ট্রাম্পের হুমকির মাধ্যমে ডলারের আধিপত্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না, বরং তিনি নিজেই প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থা থেকে নিজেকে একঘরে করে ফেলছেন।
ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কর ভারসাম্য আনবেন। তবে চীনের ক্ষেত্রে কর ১২৫ থেকে ২৪৫ শতাংশে উন্নীত হলেও চীন তাদের কর ৮৪ শতাংশেই রেখেছে। শুল্কনীতি স্থগিত হলেও চীনের ওপর তা প্রযোজ্য হয়নি। ট্রাম্প চেয়েছিলেন, চীনা প্রেসিডেন্ট ফোন করে আলোচনার প্রস্তাব দেবেন, কিন্তু শি চিনপিং কোনো তড়িঘড়ি প্রতিক্রিয়া দেখাননি। বরং চীন বোয়িংয়ের কাছে নতুন বিমান অর্ডার বন্ধ করেছে এবং মার্কিন যন্ত্রাংশ আমদানিও স্থগিত করেছে। বোয়িংয়ের সবচেয়ে বড় বাজার চীন হওয়ায় এতে যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।
চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পণ্যের আমদানি ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছে। মার্কিন ইলেকট্রনিক পণ্য, যা চীন থেকে বেশি আমদানি হয়, এখন মার্কিনদের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। বর্তমানে ৫৬ শতাংশ মার্কিনি ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বাজারে অস্থিরতা বাড়ছে এবং বিশ্লেষক রে ডালিউ আশঙ্কা করছেন, মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বড় ধরনের মন্দা দেখা দিতে পারে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি বলেছেন, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে কেউ লাভবান হতে পারে না। আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা দরকার। বিশ্বজুড়ে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় না গিয়ে ট্রাম্পের গোঁয়ার্তুমি শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির কারণ হবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে বিকল্প পণ্য আমদানির পথ প্রায় নেই, আর নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অনেক বছর সময় লাগবে। এই সময়ের মধ্যে চীন প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে যাবে।
২০২৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষীণ হয়ে যেতে পারে। সামরিক শক্তি ছাড়া চীন ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমান হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আগামী দশকে চীন বৈশ্বিক নেতৃত্বে শীর্ষে চলে যেতে পারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে যুক্তরাষ্ট্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারে, যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ছাড়া বিশেষ মিত্র খুঁজে পাবে না, শুধু যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া ব্যতিক্রম হতে পারে। চীন, রাশিয়া ও তুরস্কের নেতৃত্বে একটি ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে।
চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ২৯৫ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে ৪৩৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, আর চীনে রপ্তানি করে ১৪৪ বিলিয়নের মতো। এই ঘাটতি ধীরে ধীরে কমানো যেত, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা না করে একতরফাভাবে শুল্ক আরোপ করেছে, যা সমস্যার সমাধান নয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যুক্তরাষ্ট্র এখন আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার বা মুক্তবাজারের প্রতিনিধি হিসেবে কোনো আশার প্রতীক হয়ে উঠতে পারছে না। তারা এখন এককভাবে পথ চলার চেষ্টা করছে। প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে কীভাবে টিকে থাকবে? তাদের আর্থ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নীতির ভবিষ্যৎ রূপ কেমন হবে? অনেকে মনে করেন, বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প খুঁজে নিতে পারে না, বরং ট্রাম্পের পরিবর্তে বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি প্রয়োজন।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta