একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং সেনাবাহিনীর উত্থান
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়। বাঙালি জাতি তাদের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার জন্য এক অসম যুদ্ধে অংশ নেয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণের ওপর শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্যের ফলে স্বাধীনতা অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। এই মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি সেনারা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তাদের জীবন বাজি রেখে এক নতুন জাতির জন্মের জন্য লড়াই করেছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ইতিহাসের একটি অসাধারণ সংগ্রাম, যা লাখো মানুষ ও সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল। এটি ছিল এক সশস্ত্র প্রতিরোধ, যেখানে সেনাবাহিনী একটি বড় ভূমিকা পালন করে যুদ্ধজয়ের পথ তৈরি করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রথমে একটি জন আন্দোলন থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধে পরিণত হয়, যার নেতৃত্বে ছিল বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে বাঙালি সেনারা এবং সাধারণ মুক্তিকামী মানুষ একত্র হয়ে 'মুক্তিবাহিনী' গঠন করেছিল। এ বাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সেনারা, যারা দেশমাতৃকার জন্য জীবন দিয়েছেন।
বৈষম্য ও শোষণের পটভূমিতে সেনাবাহিনীর উদ্ভব
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর বাঙালি সেনারা অত্যন্ত বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবিচারের ফলে তারা শোষিত হয়ে পড়েছিল। তাদের শারীরিক সক্ষমতা এবং দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে তারা অবহেলিত ছিল এবং সামরিক বাজেটের বেশিরভাগ অংশ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হতো। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী 'অপারেশন সার্চলাইট' চালালে, বাঙালি সেনাসদস্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এই সময় ২৬ হাজার বাঙালি অফিসার ও সৈন্য মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়।
মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর ঐতিহাসিক ভূমিকা
১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালির ওপর আক্রমণ করলে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা জনগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত হয়। সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব এবং অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারত না। সশস্ত্র সম্মুখযুদ্ধে সেনারা সাধারণ জনগণের সঙ্গে একত্র হয়ে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে অংশ নেয়।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে কর্নেল (পরে জেনারেল) ওসমানী নিযুক্ত হন। তিনি যুদ্ধের পরিকল্পনা করে দেশকে বিভিন্ন সেক্টরে বিভক্ত করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে দেশের জন্য এক ঐতিহাসিক যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরি করেন, যা বিজয়ী হয়।
ব্রিগেডের নেতৃত্ব ও যুদ্ধ কৌশল
জেড ফোর্স, এস ফোর্স, এবং কে ফোর্স মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বাহিনী ছিল। জেড ফোর্সের নেতৃত্বে লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান এবং এস ফোর্সের নেতৃত্বে লে. কর্নেল কে এম শফিউল্লাহ মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। কে ফোর্সের নেতৃত্বে লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে মুক্তিযুদ্ধের এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেন।
মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধ কৌশল
জেনারেল এম এ জি ওসমানী গেরিলা কৌশলের ওপর জোর দেন এবং 'তেলিয়াপাড়া কৌশল' প্রবর্তন করেন। এই কৌশল অনুযায়ী গেরিলা বাহিনীর অতর্কিত হামলা এবং শত্রু সরবরাহ লাইনের ওপর আক্রমণ করা হয়। তিনি বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতিটি সেক্টরে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এই যুদ্ধ কৌশলের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে দুর্বল করে দেওয়া হয়।
উপসংহার : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের সাহস, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে, পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের অবদানে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।
লেখক : অধিনায়ক, আর্মি মিলিটারি পুলিশ ইউনিট, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta