পেছনে ফিরে দেখা
ইংরেজি প্রবচন আছে, ‘ওনলি দ্য ওয়েরার নোজ হয়ার দ্য স্যু পিন্স।’ যার পায়ে কাঁটা বিঁধে, সেই বোঝে ব্যথার তীব্রতা। গত কয়েক দিন ধরে আমিও তেমনই এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। অনেক চেষ্টা করেও এক নাটকের নাম মনে করতে পারছি না। নাট্যকারের নাম ঠিকই মনে আছে—কিরণ মৈত্র। তাঁর লেখা এক দৃশ্য মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু নাটকের নাম একেবারেই মনে পড়ছে না। কী যে অস্বস্তি!
নাটকের একটি দৃশ্যে ছোট কাকা ও আট বছর বয়সি ভাইপোর মধ্যে কথোপকথন হচ্ছে। ‘মা কি আর কখনো সুস্থ হবে না কাকু?’ প্রশ্ন করে ভাইপো। কাকা বলে, ‘হবে, তবে ভালো চিকিৎসা দরকার।’ ভাইপো জানতে চায়, ‘চিকিৎসা করানো হচ্ছে না কেন?’ কাকা বলে, ‘টাকার অভাবে।’ তখন ভাইপো জানতে চায়, ‘টাকা নেই কেন?’ কাকা উত্তর দেয়, ‘কারণ আমরা গরিব।’ এরপর ভাইপো আবার প্রশ্ন করে, ‘আমরা গরিব কেন কাকু?’
এ কথায় কাকা রেগে গিয়ে ভাইপোকে চড় মারে এবং বলে, ‘ভাগ, ফাজিল ছেলে!’ শিশুটি কাঁদতে থাকে। কান্নার শব্দে দাদা এসে জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে দাদু?’ নাতি বলে, ‘কাকু আমায় মেরেছে।’ দাদা ছোট ছেলেকে প্রশ্ন করে, ‘ওকে মারলি কেন?’ ছোট ছেলে উত্তর দেয়, ‘ও জিজ্ঞেস করছিল আমরা গরিব কেন!’ দাদা বিস্মিত হয়ে বলে, ‘তাই বলে একটা শিশুকে মারলি?’
ছোট ছেলে বলে, ‘হ্যাঁ, পারলাম। কারণ ও আজ জানতে চাইছে আমরা গরিব কেন। কাল হয়তো জিজ্ঞেস করবে আমরা মানুষ কেন কাকু! তখন কী উত্তর দেব?’
২. দারিদ্র্যের নির্মম বাস্তবতায় কেউ নিজেকে শেষ করে ফেলে, আবার কেউ লড়াই করে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যায়। আমি এমন বহু মানুষের গল্প জানি, যারা দারিদ্র্যের অন্ধকার পেরিয়ে সাফল্যের আলোয় পৌঁছেছেন। তবে কেউ কেউ বিত্তশালী হয়ে নিজেদের অতীত অস্বীকার করতে চায়। তারা এমন ভান করে যেন সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মেছিল। তারা দাবি করে, ধনী হওয়ার জন্য কখনোই অন্যায় পথে হাঁটেনি, আর কেউ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললে তা নিছক ঈর্ষার বহিঃপ্রকাশ।
তবে সত্যকে অভিশাপ দিয়ে দমিয়ে রাখা যায় না। বিত্তশালীদের কিছু আচরণ করুণার উদ্রেক করে। প্রকৃত সাফল্যের কাহিনি হচ্ছে সেইসব মানুষের, যারা দুঃখের দিন ভুলে যায়নি, বরং তা অন্যদের সাথে ভাগ করে নিয়ে সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। হয়তো সেই ভাবনা থেকেই হেমন্ত মুখার্জি গেয়েছেন, ‘যাবার বেলায় পথিক যখন পিছন ফিরে চায়/ফেলে আসা দিনকে ভেবে মন যে ভেঙে যায়।’ আজ তিনজন বিশিষ্ট মানুষের গল্প তুলে ধরছি—কুমিল্লার হিশাম উদ্দিন, লক্ষ্মীপুরের ড. বশির আহমেদ খান এবং আর্জেন্টিনার দিয়াগো ম্যারাডোনা।
৩. ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ‘আজকের সূর্যোদয়’ পত্রিকায় ‘বালিশকথন’ নামে কলাম লিখতাম। ২০০১ সালের এপ্রিল সংখ্যায় আমার শৈশবের এক স্মৃতি লিখেছিলাম, যেখানে বাবার মুখে শোনা আমার আমপ্রেমের গল্প ছিল।
ছয়-সাত বছর বয়সে মাঝরাতে ঘুম ভাঙলেই ‘আম দাও, আম খাব’ বলে কান্না করতাম। এতে বাবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটত। তিনি সমাধান হিসেবে খাটের নিচে আম ভর্তি ঝুড়ি রাখতেন। যখনই কান্না জুড়ে দিতাম, তিনি হাত বাড়িয়ে আম দিতেন।
এই লেখাটি পড়ে সৌদি আরবের দাম্মামে কর্মরত প্রকৌশলী হিশাম উদ্দিন আমার সাথে কথা বলতে চান। এক সন্ধ্যায় ফোন করে তিনি নিজের গল্প শোনান।
হিশামের বাবা ছিলেন সরকারি অফিসের কেরানি। অনটনে জর্জরিত পরিবারে ছয়জন সদস্য। তিন দিনে একবার ছয়টি আম কেনা হতো। সকালের নাশতায় সবার জন্য দুধ দিয়ে আম থাকত, কিন্তু বাবা বলতেন, ‘অফিসে নিয়ে যাব, দুপুরে খাব।’ এতটুকু বলে হিশাম কান্নায় ভেঙে পড়েন।
বাবা ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে নিজের জন্য রাখা আমটি পকেট থেকে বের করে দিতেন ছেলেকে। হিশাম বলেন, ‘বাবার আত্মত্যাগ বুঝতাম, কিন্তু আমের লোভ সামলাতে পারতাম না। আজ আমার সামর্থ্য আছে প্রতিদিন দশ ডজন আম কেনার, কিন্তু বাবা নেই।’
৪. বশির আহমেদ খান কলেজে পড়ার সময় আমাদের বাড়িতে লজিং থাকতেন। লক্ষ্মীপুরের দরিদ্র পরিবারের সন্তান বশির আট বছর বয়সে মা এবং দশ বছর বয়সে বাবা হারান। চাচা নিসারউল্লাহ তাঁকে লালন করেন। চাচি বশিরকে চাকরের মতো ব্যবহার করতেন।
অত্যন্ত মেধাবী বশির ধীরেন সরকার নামে এক শিক্ষকের সহযোগিতায় ভালো রেজাল্ট করেন। পরবর্তীতে তিনি গণিতে পিএইচডি অর্জন করে যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হন। দেশে ফিরে তিনি জানতে পারেন, তাঁর চাচা কিছুদিন আগে মারা গেছেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত বশির স্যার বলেন, ‘চাচার কোনো সেবা করতে পারলাম না।’
তাঁর চাচি অসুস্থ হলে তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে নিতে চান। আমরা অবাক হয়ে বলি, ‘আপনার সেই চাচি?’ তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, তিনি আসলে খারাপ মানুষ নন, নিরাপত্তাহীনতা থেকেই এমন আচরণ করতেন।’
৫. ১৯৮৯ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধিত হন দিয়াগো ম্যারাডোনা। তিনি সেখানে বলেন, ‘আমি ফুটবল খেলে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছি। কিন্তু আমার কৈশোর কেটেছে খাবারের জন্য কুকুরের সঙ্গে লড়াই করতে করতে...।’ কান্না চেপে রাখতে না পেরে থেমে যান। উপস্থিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও কেঁদে ওঠেন। ত্রিশ মিনিট ধরে হলভর্তি মানুষ নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়।
লেখক : সাংবাদিক
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta