এক টাকা উপার্জন করতে আড়াই টাকা খরচ
রেল সেবা খাতে লোকসান ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই গণপরিবহন ব্যবস্থার ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও আয় বৃদ্ধি পায়নি। বরং আয়ের তুলনায় ব্যয় প্রায় আড়াই গুণ। ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় যেন একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়মিত ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে, বিলম্বের কারণে যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। নানা সমস্যার কারণে অনেকেই রেলপথ ব্যবহার থেকে বিরত হচ্ছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে এক টাকা আয় করতে রেলকে দুই টাকা ৫৬ পয়সা ব্যয় করতে হচ্ছে। গত ১৫ বছরে রেলে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে, অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে যে, রেলে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং তদারকির অভাবে লোকসান বাড়ছে। গত এক দশকে রেলের উন্নয়নে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও ট্রেনের গতি বা সুবিধা বৃদ্ধি পায়নি। বরং কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করে অনেকেই লাভবান হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্নীতি রোধ ও সঠিক মনিটরিং করলে এবং টিকিট বিক্রি ও জরিমানা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা গেলে রেলকে লাভজনক করা সম্ভব।
বাংলাদেশ রেলওয়ের গত বছরের ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) আয় থেকে জানা যায়, যাত্রী পরিবহন, মালামাল পরিবহন, পার্সেলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে রেল ৮৩৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা আয় করেছে। তবে এই ছয় মাসে রেলের পরিচালন ব্যয় ছিল ২ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি এক টাকার আয় করতে রেলকে ২ টাকা ৫৬ পয়সা ব্যয় করতে হয়েছে। গত বছরও এক টাকার আয় করতে রেলকে ২ টাকা ৯০ পয়সা ব্যয় করতে হয়েছিল।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রেল পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রশিক্ষিত এক্সপার্টদের প্রয়োজন। কারণ বর্তমানে রেলের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যস্ত এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত।
তিনি বলেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যাত্রী সেবা বাড়ানোর পরিবর্তে বারবার ভাড়া বাড়িয়েছে। রেলওয়ে এখন উল্টো নীতিতে চলছে, সরকারের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন করতে তারা বারবার ব্যর্থ হয়েছেন।
যাত্রীদের অভিযোগ, বিনা টিকিটে যাত্রা বন্ধ করার জন্য রেলের কর্তৃপক্ষের কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি বিনা টিকিটে যাত্রা বন্ধ করা যেত, তাহলে মাসে অন্তত ১০০ কোটি টাকা আয় বাড়ানো সম্ভব হতো।
কমলাপুর এবং বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রতিদিন অন্তত ২০ হাজার যাত্রী চলাচল করেন, যাদের বেশিরভাগই টিকিট ক্রয় করেন না। রেলওয়ের অসাধু কর্মকর্তারা এ যাত্রীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করেন। বৈধভাবে যদি এই ভাড়া বা জরিমানা আদায় করা হতো, তাহলে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা আয় বাড়ানো সম্ভব ছিল।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, সড়কপথে ভাড়ার তুলনায় রেলপথে ভাড়া প্রায় অর্ধেক। সরকার ইচ্ছে করেই রেলের ভাড়া কম রাখছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে রেলের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছিল, অথচ এরপর তেলের দাম, কারিগরি ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, বেতন-ইনক্রিমেন্ট সব বেড়েছে। রেলের ভাড়া বর্তমানে দ্বিগুণ হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, বাড়তি ভাড়া আদায় করলে আয় অনেক বেশি হতো, তবে যাত্রীদের সুবিধা দিতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় ৪ হাজার একর জমি রেলের দখলে নেই। মাঝে মাঝে জমি উদ্ধারের চেষ্টা করা হলেও কার্যকর উদ্যোগের অভাব রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই জমিগুলো উদ্ধার করে সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে রেলকে লাভজনক করা সহজ হতে পারে।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta