ইহকাল ও পরকাল শান্তির মূলমন্ত্র ইহসান
মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ‘ইহসান’। এই শব্দটি সাদাসিধে হলেও এর গভীর অর্থ এবং বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। পণ্ডিতরা ইহসানকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এটি অন্যায় ও অবিচারের পরিপন্থী।
ইহসানের মানে হলো সমস্ত অশোভন এবং নিন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা এবং ভালো ও সুন্দর কাজ করা। কেউ কেউ বলেছেন, ইহসান হলো এমনভাবে দায়িত্ব পালন করা যা শরিয়ত অনুযায়ী সর্বোত্তম। আবার এক ধরনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ইহসান হলো আল্লাহর উপাসনা এমনভাবে করা যেন তাঁকে নিজের চোখে দেখা যায়। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত বিশ্বাস রাখতে হবে যে তিনি তোমাকে দেখছেন।
ইহসানের আরো একটি দিক হলো দেশ ও মানুষের কল্যাণে যতটুকু সম্ভব সহায়তা ও মঙ্গল সাধন করা। এক কথায়, ইহসান একটি মহান গুণ যা সব উন্নত গুণের মিশ্রণ। এটি মানুষকে কল্যাণমুখী হতে শেখায় এবং মানুষের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে।
ইহসান মানুষকে নিঃস্বার্থ দান, আত্মত্যাগ, অহংকারহীন সাহায্য এবং অন্যদের সম্মান প্রদর্শন করতে শিখায়।
মহান আল্লাহ এই গুণের অধিকারী, কারণ তিনি তাঁর সৃষ্টির প্রতি দয়া এবং সব কল্যাণ ও অনুগ্রহের মূল উৎস। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহই তো, যিনি পৃথিবীকে তোমাদের বসবাসের স্থান করেছেন, আকাশকে ছাদের মতো তৈরি করেছেন, তোমাদের রূপ সুন্দর করেছেন এবং উৎকৃষ্ট বস্তু থেকে তোমাদের রিজিক দিয়েছেন। তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের প্রতিপালক। তিনি অতি বরকতময়, জগৎসমূহের প্রতিপালক।
(সুরা : মুমিন, আয়াত : ৬৪)
কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইহসানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো :
আল্লাহর ইবাদতে ইহসান : হাদিসে জিবরাইল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে রাসুল (সা.) ইহসানের এই দিকটি ব্যাখ্যা করেছেন।
তিনি বলেছেন, ইহসান হলো এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করা যেন তুমি তাঁকে দেখতে পারো, যদি তাঁকে না দেখতে পাও, তবে অন্তত বিশ্বাস রাখা যে তিনি তোমাকে দেখছেন। (মুসলিম, হাদিস : ১)
মা-বাবার প্রতি ইহসান : পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মা-বাবার প্রতি ইহসান প্রদর্শন করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত কোরো না, মা-বাবার সাথে সদ্ব্যবহার করো, এবং যদি মা-বাবা বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে তাদের প্রতি অসম্মানজনক কথা বলো না এবং তাদের ধমকিও দিও না; বরং সম্মানের সঙ্গে তাদের সাথে কথা বলো। (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৩)
এই আয়াতে মা-বাবার প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে ইহসান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেশীর প্রতি ইহসান : নবীজি (সা.) প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন যাতে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিবেশীর প্রতি ইহসানের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী, সে যেন তার প্রতিবেশীকে সম্মান দেয়। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৬৭২)
এতিম ও দরিদ্রদের প্রতি ইহসান : এতিম ও গরিবদের প্রতি ইহসান মানুষের হৃদয়কে নরম করে। কোরআনে আল্লাহ মা-বাবার পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন, এতিম ও মিসকিনদের সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এবং (সেই সময়ের কথা স্মরণ কর) যখন আমি বনি ইসরাঈল থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম যে তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না, মা-বাবার সাথে ভালো ব্যবহার করবে এবং আত্মীয়-স্বজন, এতিম ও মিসকিনদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৮৩)
লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ইহসান : মুমিনদের উচিত আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করা এবং ইনসাফ বজায় রাখা, হারাম ও জুলুম থেকে বিরত থাকা। কোরআনে আল্লাহ ইনসাফ ও ইহসানের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ, দয়া এবং আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক প্রদান করার নির্দেশ দেন এবং অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন। (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০)
বিতর্কে ইহসান : কোরআনে বলা হয়েছে, 'তুমি নিজের প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডেকো, হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে এবং বিতর্কে তাদের সাথে উত্তমভাবে আলোচনা করো।' (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৫)
পশুপাখির প্রতি ইহসান : পশু-পাখির প্রতি সদাচরণের মধ্যে তাদের খাবার ও পানি প্রদান, যত্ন নেওয়া এবং প্রয়োজন হলে চিকিৎসা করা অন্তর্ভুক্ত। রাসুল (সা.) পশু জবাইয়ের সময় ছুরি ভালোভাবে ধার করার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে পশু কষ্ট না পায়।
হজরত ওমর (রা.)-ও পশুদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, যেন কোনো পশুর সামনে আরেকটি পশুকে জবাই না করা হয়। এটি ইসলামের অন্যতম শিক্ষা, যা শুধু মানুষের জন্য নয়, বরং সব সৃষ্টির জন্য প্রযোজ্য।
কথাবার্তায় ইহসান : কথাবার্তায় উত্তম ভাষা ব্যবহার এবং সম্মানজনক শব্দ প্রয়োগ করাও এক ধরনের ইহসান। একজন মুসলমানের উচিত সুন্দর ভাষা ব্যবহার করা যাতে বিরোধ সৃষ্টি না হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, "আমার (মুমিন) বান্দাদের বলো, তারা যেন উত্তম কথা বলে, কারণ শয়তান মানুষের মধ্যে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে।" (সুরা : ইসরাঈল, আয়াত : ৫৩)
এই আলোচনাগুলি স্পষ্ট করে যে, যদি মানুষ তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইহসান অনুসরণ করতো, তাহলে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যেত। সমাজের চিত্র পাল্টে যেত এবং পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়ে যেত।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইহসান অনুসরণ করার তাওফিক দিন। আমিন।
বিডি প্রতিদিন/মুসা
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta