ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কেমন হবে?
ভারত বাংলাদেশের স্থলবন্দর থেকে নয় প্রকার পণ্য আমদানিতে নতুন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার পর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সংকটে পড়ার আশঙ্কা বেড়েছে। বিশেষত স্থলবন্দর ব্যবহার করে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বন্ধ হওয়ার কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। খবর বিবিসি।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও রাজবাড়ী জুট মিলসের চেয়ারম্যান শেখ শামসুল আবেদিন জানান, তারা ভারতের নতুন সিদ্ধান্তের প্রভাব পাট শিল্পে কতটা পড়বে তা মূল্যায়ন করছেন। কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ হতে পারে, তবে নৌপথ ব্যবহার করে রপ্তানি চালিয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজছেন তারা।
ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ও বাণিজ্য বিশ্লেষক মোস্তফা আবিদ খান বলেন, ‘যদি স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়, তাহলে নৌপথে তা চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।’
সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মন্তব্য করেন, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে এই ধরণের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্যই সবচেয়ে ক্ষতিকর। তিনি বলেন, ‘পোশাকের পর এবার পাট রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হলো, তাই আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধান দরকার।’
তবে ভারতের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো মন্তব্য আসেনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
উল্লেখ্য, গত বছর ৫ আগস্ট বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দুই দেশের সম্পর্ক অবনতির পথে হাঁটছে। বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ কিছু বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে রাজনৈতিক উত্তেজনা ব্যবসায়েও প্রভাব ফেলেছে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, এই রাজনৈতিক উত্তেজনা যত দ্রুত মিটবে, দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক তত দ্রুত স্বাভাবিক হবে।
ভারতের ঘোষণা কী বলেছে
শুক্রবার ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে নয় প্রকার পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে মুম্বাইয়ের নহ্ভা সেভা বন্দর দিয়ে এসব পণ্য আমদানি করা যাবে।
স্থলবন্দর দিয়ে নিষিদ্ধ পণ্যের মধ্যে প্রধানত রয়েছে কাঁচা পাট, পাটের সুতা, পাটজাত কাপড়সহ বিভিন্ন পাটজাত দ্রব্য।
ভারতের এই নিষেধাজ্ঞায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ১৫ কোটি ডলারের বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যার বেশিরভাগই স্থলবন্দর দিয়ে যেত।
রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এ রপ্তানির মধ্যে মাত্র ২০ লাখ ডলার স্থলবন্দর ছাড়া অন্য মাধ্যমে রপ্তানি হয়েছে।
তবে ভারতের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্থলবন্দর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে এসব পণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ নয়।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল প্রায় ১৫৭ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানির ৩.৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ ৯০০ কোটি ডলার, যা প্রধানত ভোক্যপণ্য। পোশাকের পর পাট ও পাটজাত পণ্য ভারতের দিকে বেশি রপ্তানি হতো।
বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়বে
শুক্রবারের নিষেধাজ্ঞা ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে তৃতীয় দফার বিধিনিষেধ। এর আগে ১৭ মে পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিকসহ কয়েকটি পণ্যের আমদানি স্থলপথে বন্ধ করা হয়েছিল। এছাড়া ৯ ও ৮ এপ্রিল বিভিন্ন রপ্তানি সুবিধাও বাতিল করে ভারত।
অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ভারত দীর্ঘদিন শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়িয়ে তুলেছিল, যা এখন বন্ধ হওয়ায় দুই দেশের জন্য সংকট তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক পণ্যের ওপর ভারত নির্ভরশীল, আবার বাংলাদেশও ভারতীয় পণ্যের আমদানি করে। তাই সমস্যার দ্রুত সমাধান দরকার।’
ব্যবসায়ীরা জানান, তৈরি পোশাকের পর পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ভারতে বেশি ছিল। যদিও ২০১৭ সালে ভারত ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’ শুল্ক আরোপ করে, যা ২০২৩ সালে আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হয়েছে।
শেখ শামসুল আবেদিন বলেন, ‘শুল্ক আরোপের কারণে পাট রপ্তানি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তবুও তা ভালো ছিল। এখন কাঁচা পাট রপ্তানি সংকটের মুখে পড়তে পারে, কিন্তু নৌপথে রপ্তানির সুযোগ এখনো রয়েছে।’
পাট অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে ভারতসহ ১২ দেশে ৬৯৮ কোটি টাকার কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে, যার মধ্যে ৪৪৮ কোটি টাকার বেশি ভারতকে গেছে, মূলত স্থলবন্দর দিয়ে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৭০০ কোটি টাকার বেশি কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে ১৩ দেশে, যার মধ্যে ভারতে সর্বোচ্চ পরিমাণ গেছে।
মোস্তফা আবিদ খান বলেন, ‘ভারতে পোশাক রপ্তানি প্রায় বন্ধ হওয়ার পরে পাট রপ্তানি বন্ধ হওয়া দেশের জন্য বড় ক্ষতি হবে। স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি বন্ধের ফলে প্রভাব সরাসরি পড়বে।’
মে মাসে স্থলপথে কিছু পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন দাবি করেছিলেন, ভারত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কারণ তারা বেশি পণ্য রপ্তানি করে। তিনি আশাবাদী আলোচনা চলমান সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta