এনবিআর বন্ধ থাকবে
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ লম্বা সময় ধরে শাটডাউন চলছে। এর ফলে দেশের সব শুল্ক ও কর অফিস প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে, যেখানে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সম্পূর্ণ স্থবির। গতকাল সকাল থেকে এনবিআরের প্রধান কার্যালয়সহ দেশের সমস্ত কাস্টমস হাউস, কর কমিশনারেট, ভ্যাট ও এক্সাইজ অফিস বন্ধ রয়েছে। সকাল ৯টার পর থেকে প্রতিটি এনবিআর অফিসের দরজায় তালা ঝুলানো দেখা গেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাইরে অবস্থান নিয়ে ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছেন। এর ফলে রাজধানী ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়িক কাজকর্ম প্রায় থমকে গেছে।
বিক্ষোভের দাবি ও অবস্থা: এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের অধীনে আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগ এবং রাজস্ব বিভাগের ব্যাপক সংস্কারের দাবি জানাচ্ছেন। তারা অভিযোগ করেন, চেয়ারম্যান তাদের দাবি অগ্রাহ্য করে মিথ্যা কথা বলছেন এবং জোরপূর্বক বদলি আদেশ জারি করছেন। এই প্রতিবাদের অংশ হিসেবে গতকাল থেকে লাগাতার কর্মবিরতি এবং ঢাকার দিকে মিছিল শুরু হয়েছে। অন্যদিকে, এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে দুটি আলাদা বিভাগ গঠনের সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়েও কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। তারা মনে করেন, এই পরিবর্তন তাদের মর্যাদা ও কর্মপরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
বন্দরে কার্যক্রম বন্ধ: চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কাস্টমস কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না, যা পণ্য খালাসে বাধা সৃষ্টি করেছে। পূর্ব অনুমোদিত জাহাজগুলোর ক্ষেত্রে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর কাজ চলছে, কিন্তু নতুন কোনো জাহাজ বন্দর ঘাঁটিতে আসতে পারছে না। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ‘মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানি’র অপারেশন প্রধান আজমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘শুল্কায়ন বন্ধ থাকায় রপ্তানি কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যাবে এবং নতুন জাহাজের নিবন্ধন ব্যাহত হওয়ার কারণে বন্দর কার্যক্রম আরও সংকুচিত হবে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে জানানো হয়েছে, গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভারত থেকে কোনো আমদানি পণ্য আসেনি এবং রপ্তানি পণ্যও সেখান থেকে বাংলাদেশে যায়নি। মোহদিপুর স্থলবন্দরে শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক ও সোনামসজিদে ছয়টি রপ্তানি ট্রাক আটকা পড়েছে। স্থানীয় শুল্ক স্টেশনগুলোর সম্পূর্ণ বন্ধ থাকার কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম থেমে গেছে। পানামা পোর্ট লিঙ্ক লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মাঈনুল ইসলাম জানান, পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তারা কর্মবিরতিতে থাকায় নতুন কোনো দস্তাবেজ স্বাক্ষর হয়নি। ব্যবসায়ী নেসার আহমেদ ভূঁইয়া জানিয়েছেন, কর্মসূচির কারণে নতুন কোনো পণ্য ভারতে পাঠানো হয়নি, তবে পূর্বে সম্পন্ন কাগজপত্র সহ পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
বেনাপোল থেকে জানা গেছে, সেখানে কাস্টমস হাউসে গতকাল কোনো কার্যক্রম হয়নি। শুল্কায়ন ও লোড-আনলোড বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরা অনেক কষ্টে পড়েছেন। অনুমোদিত ছয় ট্রাক সকালে আমদানি করা হলেও রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। বেনাপোল কাস্টমসের রাজস্ব অফিসার আবু তাহের বলেন, আমদানি-রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ, কোনো কার্যক্রম চলছে না।
দিনাজপুরের হিলি কাস্টমস এলাকায় কর্মচারীরা শাটডাউনে রয়েছেন। অধিকাংশ কর্মকর্তা সেখান এসেও কাজ করেননি। হিলি কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফেরদৌস রহমান জানান, এই কর্মসূচির কারণে আমদানিকৃত পণ্য খালাস করতে পারছেন না, ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে। তারা অবিলম্বে কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন।
লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থল শুল্ক স্টেশন সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। এতে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা চরম সংকটে পড়েছেন। ভারতীয় চ্যাংড়াবান্ধা স্থলবন্দরে বহু পণ্যবাহী ট্রাক আটকা পড়েছে। অনেক পণ্য পচে যাওয়ার আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। ব্যবসায়ীরা লক্ষ করছেন, এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা কঠোর: রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর কার্যালয়ের আশপাশে বিপুল সংখ্যক পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড মোতায়েন রয়েছে। কার্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা ঝুলানো রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী কাউকে ভিতরে প্রবেশ বা বাইরে বের হতে দিচ্ছেন না।
এনবিআরের সতর্কবার্তা: এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা আল আমিন শেখের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সরকারি কর্মচারীরা অনুমতি ছাড়া কর্মস্থল ত্যাগ, অনুপস্থিতি বা দেরিতে আসাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। রাজস্ব আদায়ের শেষ মুহূর্তে কর্মীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এই আন্দোলনের কারণে সেবা ব্যাহত হচ্ছে এবং দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
আলোচনার প্রস্তাব: অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গত বৃহস্পতিবার এক বৈঠকে আগামী মঙ্গলবার এনবিআর, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা এখনও তাদের কর্মসূচি বজায় রেখেছেন। ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে, তারা আলোচনায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সংকট ও বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ: এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাসান মুহাম্মদ তারেক রিকাবদার বলেন, ‘চেয়ারম্যানের অপসারণ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। আমরা সকলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য সংস্কার চাই এবং মঙ্গলবারের বৈঠকে যোগ দিতে প্রস্তুত।’ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম বলেন, ‘এই আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে আমদানি-রপ্তানিতে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে এবং বন্দরে সম্পূর্ণ অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে।’
মোটের ওপর, জুন মাস রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে ব্যস্ত সময়, যখন সরকারের আয়ের বড় অংশ আসে। এই সংকট দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta