বড় সমস্যায় ঢাকার বানর
একসময় ঢাকার অলিগলি, বিশেষত পুরান ঢাকার সরু রাস্তা এবং প্রাচীন গাছপালাগুলো ছিল বানরদের চলাফেরার জন্য আদর্শ জায়গা। বানরদের আধিক্যের কারণে পুরান ঢাকার এক অঞ্চলের নাম হয়ে ওঠে ‘বানরটুলী’। আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা কমিশনের মধ্যে ছিল ‘বানরতলা’। খাবারের খোঁজে বানররা পিছু হতো, খাবার পেলেই খুশি হয়ে চলে যেত। এলাকা গুলো দিনভর বানরের কিচিরমিচির শব্দে মুখর থাকত। কিন্তু এখন সেই দৃশ্যগুলো দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে। শহরে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ভবন নির্মাণ, গাছপালা কেটে ফেলা, খাদ্য সংকট, মানুষের নির্যাতন, পাচার এবং বিদ্যুতের তারে শক খেয়ে মৃত্যু—এইসব কারণে ঢাকার ঐতিহ্য বানর বিলুপ্তির পথে।
ঢাকায়, বিশেষত পুরান ঢাকায় বানরদের ইতিহাস কবি-সাহিত্যিক এবং গবেষকদের লেখায় উঠে এসেছে। সত্যজিৎ রায় তার ‘সত্যজিৎ স্মৃতি’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “আমার মামার বাড়ি ওয়ারীতে, র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে। সে বাড়ি এখন আছে কি না জানি না। সে রাস্তা এখন আছে কি না জানি না। বাড়ির কথা কিছু মনে নেই। মনে আছে শুধু যে প্রচন্ড বাঁদরের উপদ্রব।” ‘টিকাটুলীর প্রাণীজীবন’ শীর্ষক বইয়ে গবেষক আফসান চৌধুরী লিখেছেন, “একটা সময় ছিল, যখন ঢাকায় মানুষের তুলনায় বাঁদরের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। আজকের দিনে বাঁদর প্রায় নেই বললেই চলে।” মীজানুর রহমানের ‘ঢাকা পুরাণ’ এবং নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তীর ঢাকা’ বইয়েও বানরের কথায় বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সেখানে বানরের সঙ্গে মজা করার পাশাপাশি তাদের হত্যার বিষয়ও উঠে এসেছে।
পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের ধারণা, এক সময় বানরগুলো আশপাশের জঙ্গল থেকে ঢাকায় আসত। মানুষ যখন খাবার দিত, বানরগুলো সেখানে অবস্থান করতে শুরু করে। তবে খাবারের উৎস কমে যাওয়ার পর বানরগুলো ফিরে যেতে পারেনি। কাজী রাকিব নামের এক বাসিন্দা জানান, “ছোটবেলায় অনেক বানর দেখতাম। আমরা খাবার হাতে ডাক দিলে তারা চলে আসত। সবাই তাদের খাবার দিত। তখন রাস্তায় দল বেঁধে বসে থাকত।” গেন্ডারিয়ায় সাধনা ঔষধালয়ে কিছু বানর এখনো রয়েছে। ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ঔষধালয়ে বানরদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
ঢাকায় বানরের উপস্থিতি কয়েক শতাব্দী পুরোনো। ধারণা করা হয়, মুঘল আমল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বানর ছিল। তখন শহরের নানা স্থানে বানরের বড় দল দেখা যেত। ব্রিটিশ শাসনামলে বানরের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশরা ঢাকায় পার্ক এবং বাগান তৈরি করলে বানরগুলো সেখানে আশ্রয় নেয়। পুরান ঢাকার ইসলামপুর, ফরাশগঞ্জ, চকবাজার, বংশাল এবং শাঁখারী বাজার এলাকায় বানরদের অবাধ বিচরণ ছিল। আজকাল বানরের সংখ্যা খুবই কমে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে ঢাকায় হাজার হাজার বানর ছিল, এখন তা কমে ৩০০-৫০০-এর মধ্যে নেমে এসেছে।
পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে আগামী দশকে ঢাকার শহর থেকে বানররা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাবে। এটি প্রাণীজগতের জন্য বড় বিপর্যয় হতে পারে। বানর সংরক্ষণের জন্য অভয়ারণ্য তৈরি করা, বানরের প্রতি আক্রমণ বন্ধ করা, নতুন গাছ লাগানো এবং পুরোনো গাছ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। বন বিভাগ, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো একসঙ্গে কাজ করলে বানর রক্ষা করা সম্ভব হবে। প্রাকৃতিকভাবে বানরের খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য ফল গাছ লাগানো যেতে পারে।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta