পিঠাপুলির সোনালী সময়
পিঠা বাঙালির সংস্কৃতিতে একটি খাবারের চেয়ে অনেক বেশি, এটি একটি ঐতিহ্য যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহিত। শীতকাল এলেই গ্রামাঞ্চলে পিঠা তৈরির উত্সাহ বেড়ে যায়, আর এটি গ্রামবাংলার বিশেষ ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক শহরেও পিঠা তৈরি ও বিক্রির প্রচলন এখনও চালু রয়েছে, যেখানে নানা ধরনের সুস্বাদু পিঠা বিক্রি হয়।
নতুন আমন ধানের চাল, খেজুর গুড়, নারিকেল এবং অন্যান্য উপকরণ দিয়ে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পিঠাগুলো তৈরি হয়। এসব পিঠার উল্লেখ প্রাচীন সাহিত্যেও পাওয়া যায়। 'পিঠা' শব্দটি সংস্কৃত শব্দ 'পিষ্টক' থেকে এসেছে, যার মানে হল চূর্ণিত বা মসৃণ করা।
পিঠা তৈরির ঐতিহ্য পাঁচশ বছরেরও পুরোনো হলেও সময়ের সঙ্গে এটি সামাজিক অনুষ্ঠান এবং পারিবারিক পরম্পরার অংশ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে পৌষ সংক্রান্তি, নবান্ন, এবং চৈত্র সংক্রান্তি উৎসবগুলোতে পিঠার ভূমিকা অপরিহার্য। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান ঘরে ওঠার পর পিঠা তৈরির উৎসব শুরু হয়, যেখানে খেজুর গুড়, নারকেল, দুধ ও দুধের ক্ষীর দিয়ে নানা ধরনের পিঠা তৈরি হয়।
প্রসিদ্ধ পিঠাগুলোর মধ্যে চিতই পিঠা, পাটিসাপটা, দুধপুলি, ভাপা পিঠা এবং মালপোয়া অন্যতম। তবে ভাপা পিঠার মিষ্টি স্বাদ এবং চিতই পিঠার ঝাল মিশ্রিত স্বাদ মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। চিতই পিঠার সঙ্গে রসুন-মরিচ ভর্তা, শুটকি ও অন্যান্য ভর্তা খাওয়ার প্রচলন হয়েছে। পাটিসাপটায় বিভিন্ন নকশা করা হয়। শহর বা গ্রামে, রাস্তার ধারে ভ্রাম্যমান দোকানগুলো বা পিঠা মেলায় এসব পিঠা প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠে।
শীতের সকালে গাঁয়ের বধূরা চুলার পাশে বসে পিঠা তৈরি করতে ব্যস্ত থাকে। এই সময় জামাইদের পিঠা খাওয়ানোর রীতি প্রচলিত থাকে। খেজুর গুড়ের মিষ্টি গন্ধে তৈরি পিঠা আরও সুস্বাদু হয়ে ওঠে। এছাড়া আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে পিঠা পাঠানোর রীতিও টিকে রয়েছে।
শহরের পিঠা বিক্রির ফলে এটি আয়ের একটি উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। শীতকালে পিঠা তৈরি করে বিক্রি করে মানুষ বাড়তি উপার্জন করছে। ফুটপাতে, হাট-বাজারে কিংবা পাঁচ তারকা হোটেলে পিঠা উৎসবের আয়োজন হয়েছে।
জনপ্রিয় পিঠা তৈরির পদ্ধতি-
চিতই পিঠা
শীতকাল এলেই চিতই পিঠা বানানোর জন্য মাটির পাত্র ব্যবহার করা হয়। চিতই পিঠা পুর বা দুধে ভিজিয়ে খাওয়া হয়। দুধ চিতই একটু দুধে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে এবং উপর থেকে নারিকেল দিয়ে সাজানো হয়।
পাটিসাপটা পিঠা
পাটিসাপটা পিঠা, যা চালের গুঁড়ো ও খেজুর গুড়ের মোটা আবরণে ঘন দুধের পায়েস বা নারকেল মিশিয়ে তৈরি হয়, বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়। অঞ্চলভেদে পাটিসাপটা পরিবেশন ভিন্ন হলেও সব গুলোই সুস্বাদু হয়।
ভাপা পিঠা
ভাপা পিঠা বাংলাদেশের জনপ্রিয় পিঠাগুলোর মধ্যে একটি। এটি চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় এবং ভেতরে থাকে গুড় ও নারকেলের পুর। বিভিন্ন জায়গায় এর ধরন পরিবর্তিত হলেও স্বাদ একটাই থাকে। শীতকালে এটি অনেকেই উপভোগ করে।
নকশি পিঠা
বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক নকশি শিল্পের আদলে নকশি পিঠা তৈরি করা হয়। চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি পিঠাগুলো খেজুর গুড়ের মিশ্রণে ভিজিয়ে রাখার আগে সৃজনশীলভাবে নকশা কাটা হয়।
পুলি পিঠা
পুলি পিঠা নানা উপায়ে তৈরি করা যায় তবে ঐতিহ্যবাহী পুলি পিঠা গুড় ও নারকেলের পুর দিয়ে তৈরি হয়। দুধ পুলিকে দুধে ভিজিয়ে এবং মশলা, খেজুর গুড় ও নারকেল ব্যবহার করে সুস্বাদু করা হয়। তেলে ভাজা পুলি পিঠাও জনপ্রিয়।
শীতের সকাল ও সন্ধ্যাকে আরও রঙিন করে তোলে পিঠা। শহরের বিভিন্ন জায়গায় পিঠা উৎসব বা পিঠা মেলার আয়োজন হয় যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলের পিঠা দেখতে ও খেতে আসে মানুষ। পিঠা শুধু একটি খাবার নয়, এটি একটি ঐতিহ্য এবং আনন্দের উৎস। বাংলার ঘরে ঘরে এই পিঠা-পার্বণের আনন্দ চিরকালীন হোক।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta