আমাদের ধর্ম আমাদের উৎসব
শেষমেশ পরিবর্তন হল মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম। গত শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে শোভাযাত্রার নতুন নাম হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। নাম পরিবর্তন নিয়ে নানা মতামত উঠলেও আমার বিশ্বাস এতে বর্ষবরণ উৎসবের মেজাজের কোন পরিবর্তন ঘটবে না। পয়লা বৈশাখ আমাদের প্রধান উৎসব, যা বাঙালির জীবনে একটি অন্যতম আনন্দের উপলক্ষ্য। বিশ্বের নানা দেশের মতো বাংলাদেশেও বছরের প্রথম দিনটি উদযাপন করা হয়। খ্রিস্টীয় নববর্ষ, আরবি নববর্ষ, চীনা নববর্ষসহ নানা জাতির মধ্যে এ ধরনের উৎসব উদযাপিত হয়। তবে পয়লা বৈশাখকে নিয়ে কিছু বিতর্ক তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, যদিও সরকারের কৌশল তা খুব ভালোভাবে মোকাবিলা করেছে। অতীতে পয়লা বৈশাখকে রাজনৈতিক রঙে রাঙিয়ে তোলা হয়েছিল, কিন্তু এখন সেটি জনগণের উৎসবে পরিণত হচ্ছে। পয়লা বৈশাখ শুধু একটি রাজনৈতিক দলের উৎসব নয়, এটি বাঙালির উৎসব। কিন্তু কিছু বছর আগে এটি ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বিতর্কিত করার চেষ্টা হয়েছিল।
বাংলাদেশ একটি হাজার বছরের ঐতিহ্য ধারণকারী দেশ। এখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও বাঙালি জাতি আমাদের সংস্কৃতির মূল সত্তা। আমরা ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছি এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্তে এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল, “বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি।” আমাদের জাতি কখনও ধর্মীয় উগ্রবাদী চিন্তাভাবনা চর্চা করে না, বরং আমরা সহমর্মিতা ও শান্তির পথে হাঁটি। বাঙালির ঐতিহ্য হলো, নানা ধর্মের মানুষ একে অপরের ধর্মীয় উৎসব অংশগ্রহণ করে উদযাপন করেন। বাংলাদেশের মুসলমানরা কখনও অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বা সহিংসতা প্রকাশ করেন না। তবে গত ১৫ বছরে কিছু মহল অসাম্প্রদায়িকতার নামে ধর্মহীনতার প্রচার করেছে। এই প্রকল্পটি দেশের সংস্কৃতির বিপক্ষে ছিল। ‘বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি’ এই চেতনায় আমাদের ঐতিহ্য নিহিত।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সংস্কৃতি ও ধর্মের সম্পর্ক কখনওই বিপরীত ছিল না। ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। তবুও কিছু বুদ্ধিজীবী একে বিপরীত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যা অত্যন্ত খারাপ কাজ। আমাদের সংস্কৃতি এবং ধর্মের মধ্যে একটি সুস্থ সম্পর্ক থাকতে হবে। দেশে ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলমান। তাই আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে ধর্মকে উপেক্ষা করা কিংবা বিরোধ সৃষ্টি করা উচিত নয়। সম্প্রতি পয়লা বৈশাখকে ঘিরে কিছু বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তবে আশার কথা, বাংলাদেশের ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো পয়লা বৈশাখ নিয়ে নেতিবাচক কোন অবস্থান নেয়নি। বরং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এই উৎসবের আয়োজনের জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক নীতি গ্রহণ করেছে, যা প্রশংসনীয়।
প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হয়। একটি হলো ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, আরেকটি হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান স্বাধীনতার পর থেকেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এবং এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। এই শোভাযাত্রা নব্য প্রজন্মের মধ্যে বর্ষবরণের উৎসবকে উদযাপনের এক আদর্শ পথ সৃষ্টি করে। কিন্তু গত কয়েক বছরে এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যা মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করেছে। তবে এবার শোভাযাত্রার থিম ভালোভাবে নির্বাচিত হয়েছে এবং এটি একটি আনন্দঘন উৎসব হিসেবে উদযাপিত হবে।
পয়লা বৈশাখের উৎসব, এমনকি মঙ্গল শোভাযাত্রাও, কোনো ধর্মীয় বিরোধ সৃষ্টি করবে না। এটা সবার জন্য, সব ধর্মের মানুষের জন্য আনন্দের দিন। আমাদের উচিত, এ ধরনের উৎসবকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা এবং শুধু সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে উদযাপন করা। ঈদ, দুর্গাপূজা বা ক্রিসমাসের মতো ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে কখনও বিরোধী হিসেবে দাঁড় করানো উচিত নয়। দুইটি সমান্তরাল ভাবে চলতে পারে, সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে ভারসাম্য রাখা উচিত। একে অপরের মধ্যে কোনও বিরোধ সৃষ্টি না করে আমাদের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে হবে।
অদিতি করিম, নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল : [email protected]
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta