আয়কর তদন্ত কর্মকর্তার অনুসন্ধান
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী ইউনাইটেড গ্রুপ বিদ্যুৎ খাতে প্রচুর সুবিধা পেয়েও থেমে থাকেনি। একের পর এক সরকারি সুবিধা পাওয়ার পরও এই বেসরকারি শিল্প গ্রুপটি ব্যাপক অনিয়ম করেছে। গ্রুপটির আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছে, যেখানে কয়েকটি বিদ্যুৎ কোম্পানি লভ্যাংশের উপর কর প্রদান না করায় বিশাল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি ধরা পড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তে উঠে এসেছে, গ্রুপটি সরকারের প্রায় এক হাজার ২৬০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে।
এছাড়াও, গ্রুপটির চার পরিচালক ব্যক্তিগতভাবে ৪০ কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়েছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এ অনিয়মে সহযোগিতা করেছেন দুজন কর কমিশনার। এনবিআরের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ইউনাইটেড গ্রুপের কর ফাঁকির বিষয়ে জানতে এর পরিচালক কুতুবুদ্দিন আকতার রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি কর ফাঁকির অভিযোগ অস্বীকার করেন। তার ভাষায়, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে অর্জিত আয়ে কর নেই, আয়কর বিভাগ ভুল করছে।’
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ইউনাইটেড গ্রুপের সাতটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি রয়েছে, যার মধ্যে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন, ইউনাইটেড পায়রা পাওয়ার, ইউনাইটেড আসুগঞ্জ এনার্জি, ইউনাইটেড ময়মনসিংহ পাওয়ার, ইউনাইটেড এনার্জি, ইউনাইটেড আনোয়ারা পাওয়ার এবং ইউনাইটেড জামালপুর পাওয়ার অন্তর্ভুক্ত। আগের সরকারের ক্যাপাসিটি চার্জ সুবিধায় এই গ্রুপটি সাত হাজার ৮৮০ কোটি টাকা লাভ করেছে।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, বাণিজ্যিক উৎপাদনের পরবর্তী ১৫ বছর শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে অর্জিত আয় করমুক্ত। তবে ইউনাইটেড গ্রুপের কিছু প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে তাদের লভ্যাংশ আয়ের ওপর কর ফাঁকি দিয়েছে। এনবিআরের তদন্তে উঠে এসেছে, কোম্পানিগুলো করযোগ্য লভ্যাংশকে করমুক্ত দেখিয়ে বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে।
তদন্ত বলছে, কোম্পানির পরিচালকেরা একজন আইনজীবীর পরামর্শে সুপ্রিম কোর্টে রেফারেন্স মামলা দায়ের করেন, এরপর থেকে তারা লভ্যাংশের কর প্রদান বন্ধ করেন। তবে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কর কাটা হলেও পরিচালকরা নিজেদের ক্ষেত্রে তা এড়িয়ে গেছেন।
রাজস্ব ফাঁকি এক হাজার ২৬০ কোটি টাকা
ইউনাইটেড ময়মনসিংহ পাওয়ার লিমিটেড ২০১৯-২০ করবর্ষ থেকে ২০২৪-২৫ করবর্ষ পর্যন্ত ছয় বছরে ৯৩৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা কর ফাঁকি দিয়েছে। একইভাবে ইউনাইটেড এনার্জি লিমিটেডও ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪ করবর্ষ পর্যন্ত ৩২২ কোটি ২৬ লাখ টাকা ফাঁকি দিয়েছে।
চার পরিচালকের ফাঁকি ৪০ কোটি টাকা
গ্রুপের চার পরিচালক—মঈনুদ্দিন হাসান রশিদ, হাসান মাহমুদ রাজা, খন্দকার মঈনুল আহসান শামীম ও ফরিদুর রহমান খান—নিজেদের করযোগ্য লভ্যাংশ আয়কে করমুক্ত দেখিয়েছেন। তারা মোট ৪০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছেন। পরে কর ফাঁকি বৈধ করতে তারা সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন।
যোগসাজশে প্রভাবশালী আয়কর কর্মকর্তারা
ইউনাইটেড ময়মনসিংহ পাওয়ার ও ইউনাইটেড এনার্জির কর ফাঁকির সঙ্গে কর অঞ্চল-৫-এর তৎকালীন দুই কর কমিশনারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। ২০১৮-২২ পর্যন্ত কমিশনার ছিলেন সোয়ায়েব আহমেদ, এরপর ২০২২-২৪ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন আবু সাঈদ মো. মুস্তাক। তারা নিজেদের ক্ষমতা ব্যবহার করে এই অনিয়মের অনুমোদন দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
কর বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এই দুই কর কমিশনার বিভিন্ন কর্মকর্তার ওপর চাপ প্রয়োগ করে অনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত করেছেন। যদিও বর্তমান সদস্য আবু সাঈদ মো. মুস্তাক দাবি করেছেন, তার সময়ে কোনো অনিয়ম হয়নি।
আয়কর গোয়েন্দার সুপারিশ
এনবিআরের আয়কর গোয়েন্দা বিভাগ সুপারিশ করেছে, ইউনাইটেড গ্রুপের ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব পুনরুদ্ধারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এ ধরনের কর ফাঁকি আদায় না হলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও একইভাবে কর ফাঁকি দিতে উৎসাহিত হবে, ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি বাড়বে। কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও কর ফেরত চাওয়ার দাবি তুলতে পারে, যা সরকারের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সৌজন্যে - কালের কণ্ঠ।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta