গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় শিগগিরই আসছে নতুন জ্বালানি নীতি
গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি এবং পুঁজি সহজলভ্য করতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলনে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এসব বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে সরকার। সম্মেলনে জানানো হয়, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট সমাধানে অচিরেই নতুন জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করা হবে, যেখানে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে। চলমান রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শেষ হলে প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতি হ্রাস পাবে। এতে বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত হবে বলে সরকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে অধিকাংশ সমস্যার সমাধান হবে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) উদ্যোক্তাদের প্রতি সহযোগিতার পরিমাণ বাড়াবে।
বিনিয়োগে আগ্রহী যেসব আন্তর্জাতিক কোম্পানি রয়েছে, তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। আয়োজক সংস্থা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার অঙ্গীকার করেছে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, এবারকার সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী উদ্যোক্তারা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং নীতিগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে সরকারের কার্যকর ভূমিকা দেখতে চেয়েছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা জানতে চেয়েছেন, বাংলাদেশে ব্যবসা করতে এলে কী ধরনের সরকারি সহায়তা মিলবে এবং প্রশাসনিক বাধা কীভাবে দূর করা হবে। উদ্যোক্তারা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ইপিজেড পরিদর্শন করেছেন।
তিনি আরও বলেন, সরকার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রতিটি দেশে কিছু না কিছু সমস্যা থাকে, তবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো চিহ্নিত হয়েছে এবং তা সমাধানে কার্যক্রম চলমান। আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, ৭ থেকে ১০ এপ্রিল বিডা চার দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আয়োজন করে। এতে ৪২টিরও বেশি দেশের ৪২৫ বিদেশি বিনিয়োগকারী অংশ নেন, যার মধ্যে চীনের প্রায় দেড় শতাধিক ছিলেন। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও জাপান থেকেও বিনিয়োগকারী অংশ নিয়েছেন। দেশীয় বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল দুই হাজারের বেশি। সম্মেলনে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
বিডা জানায়, বিনিয়োগকারীরা জমির অপ্রতুলতা, পুঁজির অভাব, উচ্চ সুদের হার, দুর্নীতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তুলে ধরেছেন। এর প্রতিকার নিয়ে আলোচনা হয়। ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ কেবল একটি দেশ নয়, এটি একটি বিশাল আঞ্চলিক বাজারের প্রবেশদ্বার। বিডার চেয়ারম্যান জানান, দেশের ১১ কোটি শ্রমশক্তি রয়েছে এবং ২৫ বছরের নিচে রয়েছে ৩ কোটি জনসংখ্যা। ১৮ কোটির বাজার ছাড়াও এখানে উৎপাদিত পণ্য নেপাল, ভুটান, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি করা সম্ভব।
বিনিয়োগকারীদের প্রতি তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকলেও লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি। উদাহরণ দিয়ে বলেন, গ্রামীণফোন বাংলাদেশে ৫৬.১ শতাংশ মুনাফা করেছে যেখানে বৈশ্বিক গড় ১৫ শতাংশ। লাফার্জ হোলসিমের মুনাফা ২৯.৮ শতাংশ, মারিকোর ৫৬.১ শতাংশ, যা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় অনেক বেশি।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান ছিল বিনিয়োগকারীদের অন্যতম দাবি। জবাবে বিডার চেয়ারম্যান জানান, জ্বালানি ইস্যুতে উদ্বেগ রয়েছে এবং এই সমস্যা নিরসনে নতুন জ্বালানি নীতি খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।
বিনিয়োগকারীরা লাইসেন্স পেতে জটিলতা, আমদানি-রপ্তানিতে এনবিআরের সহযোগিতা ঘাটতি এবং প্রশাসনিক বাধার অভিযোগ তুলেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার চলছে, যা সম্পন্ন হলে এসব সমস্যা দূর হবে।
প্রায় সব কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে, যা দুর্নীতি কমাতে সাহায্য করবে। উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেন, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে নীতির ধারাবাহিকতা থাকে না। এবারের সম্মেলনে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি অংশ নিয়ে নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার অঙ্গীকার করেছে।
সম্মেলনে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য সহনীয় রাখার এবং নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার পরামর্শ উঠে আসে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তাও উঠে এসেছে। দক্ষ জনশক্তি উন্নয়নকে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়।
বিডার চেয়ারম্যান বলেন, বিনিয়োগের যেসব বাধা তুলে ধরা হয়েছে, তা সমাধানে প্রস্তুতি চলছে। বিডা ইতোমধ্যে ২০টি প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ওয়ান স্টপ সার্ভিস সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। সম্মেলনের শেষে বিডার নাহিয়ান রহমান বলেন, এই সম্মেলন দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের একটি শক্তিশালী পাইপলাইন তৈরি করেছে। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা ও মনিটরিং চলবে।
তার মতে, বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে সাধারণত উদ্যোক্তাদের ১৮ থেকে ২৪ মাস লাগে। এবারের সম্মেলনে বিডা ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বাংলাদেশকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন। সম্ভাবনা ও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন সম্ভব হয়েছে।
সম্মেলনে বহু দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী অংশ নেন। স্টারলিংক পরীক্ষামূলকভাবে ইন্টারনেট চালু করে, নাসার সঙ্গে একটি চুক্তি হয়। চীনের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ১ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয়। স্পেনের ইনডিটেক্স ও আলিবাবা বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে। হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিজ ১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। ডিপি ওয়ার্ল্ড, জিওডারনো, এক্সিলারার এনার্জিসহ বিভিন্ন কোম্পানি বিনিয়োগে আগ্রহী। বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘুরে দেখেছেন।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta