নতুন সংকটে পানি
দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে উদ্বেগ বাড়ছে মানুষের মধ্যে। কৃষি খাতে দেখা দিচ্ছে বিপর্যয়। জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় দেশি মাছের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে, পাশাপাশি পরিবেশের ওপর পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। তাপপ্রবাহ শুরু হওয়ার আগেই এসব এলাকার অনেক পাম্প ও নলকূপে পানি উঠছে না, ফলে খাবার ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের পানির সংকটে মানুষ দুর্ভোগে পড়ছে।
ইরি বোরো মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষকদের মধ্যে শঙ্কা বিরাজ করছে। উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলো নিয়মিত খনন করা না হওয়ায় বর্ষা শেষে সেগুলোতে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় পানির অভাবে কৃষিজমি ফেটে যাচ্ছে, নদী, খাল, পুকুর দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে।
ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদী তার আগের বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর আকার অর্ধেক হয়ে এসেছে, কমেছে গভীরতাও। নদীর তলদেশে জেগে উঠছে বিশাল বালুচর। অববাহিকায় বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় তাপমাত্রা বেড়েছে। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে ১৯৭৭ সালের ১৬ মে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ হয়েছিল। প্রয়োজনের সময় পানির প্রবাহ কমিয়ে দেওয়া হয়, আর অপ্রয়োজনীয় সময় পানি ছেড়ে দেওয়া হয়, ফলে রাজশাহী ও আশপাশের জেলায় পানির তীব্র সংকট তৈরি হয়। রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী পানি পেলেও সংরক্ষণের অভাবে তা সাগরে চলে যায়। দীর্ঘদিন ধরে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে পানি উত্তোলন করছে, ফলে পানির স্তর ১৬০-১৮০ ফুট নিচে নেমে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের কোথাও পানির অভাবে কৃষকের আত্মহত্যার নজির নেই, কিন্তু আমাদের দেশে তা ঘটছে। কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, আর্সেনিক দূষণ বাড়ছে, দেশি মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, এমনকি পশুপাখিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।’
দেশের বৃহত্তম জলাভূমি চলনবিল, যা পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার নয়টি উপজেলায় বিস্তৃত, বর্ষা শেষেই প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়ে। অথচ একসময় সেখানে সারা বছর পানির প্রবাহ ছিল, যা এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই বিলের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। দেশি মাছ, জলচর প্রাণী ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির পথে। তিন দশক আগেও চলনবিল বর্ষার পরিপূর্ণতায় থইথই করত, যা এখন শুকনো মৌসুমে পরিণত হয়েছে মরুভূমির মতো। বর্ষার পলিযুক্ত মাটিতে ফসল ফলানো হলেও পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় পানি দ্রুত শুকিয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা এর কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ ও বৃক্ষনিধনকে দায়ী করছেন।
এ ছাড়া, মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যাও কম নয়। বিলের মধ্যে বড় পুকুর খনন করে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক আবদুর রাজ্জাক রাজু বলেন, ‘ফারাক্কা বাঁধের পানি নিয়ন্ত্রণের কারণে চলনবিলে পানি সংকট দেখা দিচ্ছে। রাজশাহীর চারঘাট এলাকায় বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য বাঁধ নির্মাণ করায় পদ্মার পানি বিল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না। ইরি বোরো মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নামছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চলনবিলে একসময় প্রচুর মৎস্যজীবী ছিল, কিন্তু পানির অভাবে তারা পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের কার্যকলাপের কারণে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। সরকারের উচিত মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান করা। হাওর-বাঁওড় ও বরেন্দ্র অঞ্চলের মতো চলনবিলের দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।’গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় দ্রুত পানির স্তর নেমে যাওয়ায় কৃষকরা সেচের জন্য সংকটে পড়ছেন। বাধ্য হয়ে অনেকেই ১০-১৫ ফুট গভীর গর্ত খনন করে সেচ মেশিন বসাচ্ছেন। নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, রংপুর, পাবনা, নাটোরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকরা গর্ত খনন করেও পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন না, ফলে আবারও গভীর গর্ত করতে বাধ্য হচ্ছেন। ইরি বোরো ধান সম্পূর্ণ সেচনির্ভর, কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানি সংকটের কারণে কৃষকরা চরম বিপাকে পড়েছেন। তারা আশঙ্কা করছেন, পানির স্তর এভাবে নিচে নামতে থাকলে ভবিষ্যতে সংকট আরও ভয়াবহ হবে।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta