ট্রাম্পের ভাঁওতাবাজি এখন প্রতিটি ঘাটে আটকে যাচ্ছে।
নিয়তি সম্পর্কে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে, তা রাজনীতির ওপর কতটুকু প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে আমার কোনো নিশ্চিত ধারণা নেই। পশ্চিমা বিশ্বের কট্টরপন্থী রাজনীতিক, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্র পরিচালনায় এখন একাধিক অনাকাঙ্ক্ষিত চাপের মুখে পড়েছেন এবং অনেকেই মনে করছেন তিনি নিয়তির খেলা খেলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। চার বছর বিরতির পর দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর, প্রথাগত রাজনীতির বাইরে আসা ট্রাম্প ভাবেননি যে রাজনৈতিক সংঘাত বা যুদ্ধবিগ্রহ হবে। তিনি চাইছিলেন এবার শান্তি, শৃঙ্খলা এবং বাণিজ্য-বিনিয়োগের দিকে মনোনিবেশ করবেন।
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের সমাপ্তি এবং এক টেকসই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে ইউরোপ এবং পৃথিবীজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি। এজন্য তিনি দ্রুত পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন বলে দাবি করেছেন। কিন্তু, তিনি মনে করেন নিয়তি তার শান্তির প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। যখন তিনি ইরানের পরমাণু প্রকল্পের বিষয়ে একটি স্থায়ী সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের ওপর একতরফাভাবে আক্রমণ করে।
অনেকে এটিকে নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের পূর্বপরিকল্পিত নাটক হিসেবে দেখছেন, তবে ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক সদস্য ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে মন্তব্য করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বলেছেন, এই সংঘর্ষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক জড়িত করা হয়েছে। ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠী, যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি ধনকুবের শ্রেণি এবং আমেরিকান ইসরায়েলি পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (এআইপিএসি) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য করেছেন। অথচ, যুক্তরাষ্ট্রে অনেক চিন্তাশীল এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিলেন।
মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিনের নানা ইস্যু নিয়ে গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার সময়, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্যভাবে বদলেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনে করেছিলেন যে, এই পরিস্থিতিতে হয়তো ফিলিস্তিন সমস্যা একটি দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান খুঁজে পেতে পারে।
তবে, ইরানের বিরুদ্ধে ১৩ জুন ইসরায়েলি আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্রও সেই যুদ্ধে অংশ নেয়। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পরমাণু বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক চলাকালীন ইসরায়েল হামলা চালায়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে কোনো কৈফিয়ত চায়নি। বরং, আগ্রাসী ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য জোরপূর্বক চাপ দিয়েছেন।
বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে ইরানের পরমাণু স্থাপনার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলা এবং তার ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছায়নি, বরং তারা ৬০ শতাংশে ছিল, যা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ছিল। এরপরও কেন এ হামলা? ইরান এখন রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে।
এদিকে, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু গণমাধ্যম যুক্তরাষ্ট্রের বোমাবর্ষণের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে। তারা মনে করে, হামলার আগেই ইরান তার ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আবার কাজ শুরু করতে সক্ষম হবে। এসব কারণে ট্রাম্পের ঘোষিত যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এখন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা স্টিভ উইটকফ শিগগিরই ইরানের সঙ্গে একটি শান্তি আলোচনায় বসতে চান। কিন্তু, ট্রাম্পের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁর সিদ্ধান্ত এবং কর্মপদ্ধতি পশ্চিমা বিশ্বের অনেকের জন্য বিতর্কিত হয়ে উঠেছে।
তবে, ট্রাম্পের মতো একজন ব্যক্তি অত্যন্ত সহজে অর্থ বা শক্তি দিয়ে প্রভাবিত হতে পারেন, কারণ তার কোনো দৃঢ় নীতি বা আদর্শ নেই। তিনি বেশ কয়েকবার আর্থিক দেউলিয়াত্বের মুখোমুখি হয়েছেন এবং এখন তিনি নেতানিয়াহুর মতো বিতর্কিত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছেন।
সম্প্রতি ন্যাটো সম্মেলনে ট্রাম্পের জিডিপির ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা ব্যয়ের দাবির পর, সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এমনকি, মার্কিন অর্থনীতি বর্তমানে ৩৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণ ভারে বিপর্যস্ত, এবং যুদ্ধবাজ ইসরায়েলের কাছ থেকেও সেই চাপ বাড়ছে। এই অবস্থায় ট্রাম্পের বাইরের শক্তি এবং নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর ট্রাম্প যদি তাঁর রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারান, তবে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে একটি প্রান্তিক অবস্থানে চলে যেতে পারেন।
এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলকে আগের মতো অর্থ সাহায্য এবং সামরিক সরঞ্জাম দেওয়া সম্ভব হবে না। ট্রাম্পের বিশ্বশান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিণতির জন্য ইসরায়েলকেই বড় ধরনের দায়ী হতে হবে, তবে তাদের পক্ষপাতিত্ব এবং প্রভাব এখনো কমেনি। ট্রাম্পের নানা পদক্ষেপ এবং কৌশল এখন নানা স্তরে আটকে যাচ্ছে।
(লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক)
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta