নড়াইলে অবৈধ কয়লার ভাটা গড়ে উঠেছে, পরিবেশে বিপদের সুর.
শুনশান পরিবেশ দেখে প্রথমে মনে হবে এখানে কেউ মাটির ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন। কিন্তু কাছে গেলে দেখা যাবে ইট ও মাটির দ্বারা তৈরি গোলাকার ঢিবিতে পোড়ানো হচ্ছে হাজার হাজার মন কাঠ। উপরের অংশটি গম্বুজ আকৃতির, ভিতরে বড় আকারের ফাঁকা স্থান রয়েছে। নিচের দিকে তিন হাত উঁচু এবং দেড় হাত চওড়া একটি মুখ রয়েছে, যেখানে কাঠ ভেতরে রাখা হয়। সেগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় এটি কয়লা ভাটা নামে পরিচিত, কেউ কেউ একে কাঠ-কয়লার ভাটা বলেন। এখানে কাজ করা মানুষগুলো দেখে মনে হবে যেন তারা অন্য গ্রহ থেকে এসেছে, শরীর পুরো কালিতে মাখামাখি।
নড়াইল শহরের কাছাকাছি চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে গড়ে উঠেছে কয়লা ভাটা। অনুমোদন ছাড়া প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার মন কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করা হচ্ছে। কাঠ পোড়ানোর ধোঁয়ার ফলে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে উঠছে এলাকা। ভাটার চারপাশের ছিদ্রগুলো দিয়ে কাঠের ধোঁয়া বের হয়ে যায়। যারা এর আশেপাশে বসবাস করছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই এই সমস্যার কথা বললেও, এর প্রতিরোধের জন্য কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এলাকার প্রায় সব শ্রেণির মানুষের শ্বাসজনিত সমস্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাটা শ্রমিকরা তাদের সমস্যার কথা অস্বীকার করলেও তারা এই কাজে যুক্ত হচ্ছেন আর্থিক সচ্ছলতার জন্য। নড়াইলের গোয়ালবাথান গ্রামে এক নতুন কয়লা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে, যেখানে বনজ ও ফলজ গাছ কেটে চুল্লিতে দিয়ে কয়লা বানানো হচ্ছে। পাশের নাওরা ও বাধাল গ্রামে আরো ৪টি অবৈধ কয়লা কারখানা চলছে। সদর উপজেলা, শালিখা, দত্তপাড়া, লোহাগড়া উপজেলার কাশিপুর, সারুলিয়া গ্রামে প্রায় ২৫টি কয়লা তৈরির কারখানা রয়েছে।
নড়াইল সদর উপজেলার চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের গোয়ালবাথান গ্রামে ইউনুস মীরার জমিতে মো. রুমন মীরা পাঁচ চুলা বিশিষ্ট একটি কয়লা ভাটা স্থাপন করেছেন। নাওরা গ্রামের শেষ প্রান্তে ছয় চুলা বিশিষ্ট আরেকটি কয়লা ভাটা স্থাপন করেছেন গোয়ালবাথান গ্রামের বাবন আলীর ছেলে নাখন মীরা। একই গ্রামের শিবু খন্দকার বাধাল গ্রামে দশ চুলাবিশিষ্ট আরো একটি কয়লা ভাটা স্থাপন করেছেন যা একমাস আগে এলাকাবাসীর অভিযোগের ভিত্তিতে মোবাইল কোর্টে ভেঙে দেওয়া হয়, কিন্তু পরে আবার ম্যানেজ করে সেটি পুনরায় স্থাপন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
একটি কয়লা কারখানায় প্রতি সপ্তাহে সাড়ে ৩০০ মন কাঠ পুড়িয়ে সাড়ে ৪ টন কয়লা উৎপাদন করা হচ্ছে। সপ্তাহে ৯ হাজার মন কাঠ পোড়ানো হচ্ছে এবং মাসে ৩৫ হাজার মন কাঠ পোড়ানো হয়। এতে মাসে ৫০০ টন কয়লা উৎপাদন হয় এবং তা দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। একদিকে বন ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে বিষাক্ত ধোঁয়ার ফলে কৃষিজমির ক্ষতি হচ্ছে, এবং শিশুদের শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গোয়ালবাথান গ্রামের রুমনের কয়লা ভাটা সম্পর্কে ফরিদা ইয়াসমীন লাকী (৫০) বলেন, ‘এই ভাটার ধোঁয়া থেকে গন্ধ পেলে আমি কিছু খেতে পারি না, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। এর গন্ধে আমার বমি আসে এবং কিছু না খেয়ে গলা টানতে টানতে অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। আপনারা যদি পারেন এই ভাটা বন্ধ করে দিন।’
নাওরা সীমান্তে নাখন মীরার ভাটা সম্পর্কে আবে খাতুন (৬৫) বলেন, ‘কাঠ পোড়ানো কয়লা ভাটার ক্ষতি হলেও আমাদের কিছু বলার নেই কারণ আমার দুই ছেলে ও নাতি এখানে কাজ করে সংসার চলে।’
বাধালে শিবু খন্দকার কয়লা ভাটা সম্পর্কে শিফালী খানম (৭০), জামিরোন (৩৮), ইয়াসমীন (৪০) ও অন্যরা বলেন, ‘এই কয়লা ভাটার কারণে ছোট বড় সবাই শ্বাসকষ্টে ভুগছে। আমাদের ছোট শিশুরাও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। আশপাশের জমিতে আগের মতো ভালো ফসল হচ্ছে না, শুধু এই কয়লা ভাটার জন্য। কয়েকদিন আগে ম্যাজিস্ট্রেট এসে চুলা ভেঙে দিয়েছিল, কিন্তু পরে আবার সেটি স্থাপন করা হয়েছে।’
নড়াইলের পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল মালেক মিয়া তাদের অক্ষমতা স্বীকার করে বলেন, ‘কাঠ পুড়িয়ে কয়লা বানানো একটি অবৈধ পদ্ধতি। এর অনুমোদন দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমাদের লোকবল এবং বাজেটের সীমাবদ্ধতার কারণে নিয়মিত মনিটরিং করা সম্ভব হয় না, যার ফলে এই ধরনের অবৈধ কার্যক্রম পুনরায় স্থাপিত হয়ে থাকে। এটি প্রতিহত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।’
নড়াইলের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মাদ আব্দুর রশিদ বলেন, ‘ধোঁয়ায় ফুসফুস ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। ফুসফুসের রোগ এবং শ্বাসকষ্টসহ নানা সমস্যা বাড়ছে, প্রতি বছর প্রায় ৩ লক্ষাধিক রোগী এই সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। দিন দিন এ সমস্যা বাড়ছে।’
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta