থেমে গেল রওশন আরার সংগ্রাম, পৈতৃক জমি দখল করল চার ব্যক্তি
কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং পশ্চিমপাড়ায় জমি নিয়ে বিরোধের ফলস্বরূপ রক্তাক্ত সংঘর্ষের পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন রওশন আরা (৩৮)। তিনি সংঘর্ষে নিহত আব্দুল মান্নানের বড় বোন। এই ঘটনায় একটি জমির কারণে চারটি তাজা প্রাণ ঝড়ে গেছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মঙ্গলবার রাত ১টা ১৫ মিনিটে রওশন আরা মারা যান। তার স্বামী মো. শাহজাহান জানান, "ঘটনার দিনই তাকে গুরুতর অবস্থায় কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। এখানে আইসিইউতে দুইদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার পর তিনি মারা যান।"
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, রওশন আরাকে ছুরি ও কুড়াল দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছিল, এবং তার মাথায় গুরুতর আঘাতের চিহ্ন ছিল।
গত ৬ এপ্রিল বিকেলে জমি নিয়ে বিরোধের কারণে আপন চাচাতো ভাইদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে একই পরিবার। ওই দিনই নিহত হন মাওলানা আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৮), মো. আব্দুল মান্নান (৩৬), এবং মান্নানের বড় বোন শাহিনা আক্তার (৩৮)। রওশন আরার মৃত্যুর ফলে মৃতের সংখ্যা চারজনে পৌঁছাল।
নিহত মাওলানা মামুন কুতুপালং বাজার জামে মসজিদের খতিব ও জামায়াতে ইসলামির স্থানীয় নেতা ছিলেন। ধর্মীয় নেতৃত্ব এবং রক্তের সম্পর্ক সব কিছুই হারিয়ে গেছে সহিংসতার তীব্রতায়।
স্থানীয়রা জানান, আব্দুল মান্নান কিছু বছর আগে পৈতৃক জমি বিক্রি করেছিলেন। ওই জমি বুঝিয়ে দেওয়ার সময় মামুনের পরিবার বাধা দেয়, এবং বাকবিতণ্ডা থেকে সংঘর্ষে পরিণত হয়।
এই মর্মান্তিক ঘটনার পর পুরো কুতুপালং পশ্চিমপাড়ায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নিহতদের পরিবার뿐 নয়, পুরো এলাকা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। অনেকেই এই ঘটনায় শুধুমাত্র পারিবারিক বিরোধ নয়, সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতাকেও দায়ী করছেন।
কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, “এটি শুধুমাত্র জমির বিরোধ নয়, এটি আমাদের সমাজের অবক্ষয়ের একটি প্রকাশ। আজ ভাই ভাইকে কুপিয়ে মারছে। আমরা কী ধরনের সমাজে বাস করছি?”
স্থানীয় সমাজকর্মী রাশেদা পারভীন বলেন, “একই পরিবারের চারজনের মৃত্যু সাধারণ ঘটনা নয়। নারীদেরও হত্যা করা হয়েছে, এবং ছুরি–কুড়াল দিয়ে এমন নৃশংস হত্যা প্রমাণ করে আমাদের সহিংসতা কতটা নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। এর দায় শুধু পরিবার নয়—স্থানীয়ভাবে যারা সালিশি ভূমিকা নিতে পারতেন, তারা কোথায় ছিলেন?”
স্থানীয় যুবক সাইফুল আলম বলেন, “আমরা আগে থেকেই জমি নিয়ে বিরোধের কথা শুনেছি। চেষ্টা করেছিলাম স্থানীয়ভাবে সমাধান করতে, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। যারা দায়িত্বশীল ছিলেন, তাদের জবাবদিহি করতে হবে।”
কুতুপালং বাজার বণিক সমিতির সভাপতি মো. নুরুল হক বলেন, “এই ঘটনার কারণে এলাকার ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত দোষীদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি প্রদান করবে, এই আশা করছি।”
উখিয়া উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী বলেন, “জমি নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের, কিন্তু কেউ ভাবেনি যে এটি এমন রক্তগঙ্গায় পরিণত হবে। ভাই-বোন একে অপরকে এমনভাবে খুন করতে পারে, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহিদুল করিম বলেন, “গ্রামীণ সমাজে জমি নিয়ে বিরোধ নতুন কিছু নয়, তবে আইনের দুর্বলতা এবং পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এমন ঘটনার জন্ম দিয়েছে।”
উল্লেখ্য, উখিয়া থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। এক টুকরো জমির জন্য একটি পরিবার রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল, ভাইয়ের হাতে ভাই, বোনের রক্তে লেখা হল পারিবারিক বিষাদের এক শোকাবহ অধ্যায়।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta