রূপের মায়ায় সর্বনাশ
‘আজ রাত ১০টায় লাইভে থাকব। থাইল্যান্ড থেকে এনেছি এক বিশেষ ক্রিম, যা মাত্র সাত দিন ব্যবহারে ত্বকের রং উজ্জ্বল করবে’। ফেসবুকসহ নানা সামাজিক মাধ্যমে অনেক নারী উদ্যোক্তা এমন লাইভে ত্বক ফর্সাকারী প্রসাধনীর প্রচার চালাচ্ছেন। হাজার হাজার দর্শক এসব ভিডিও দেখেন এবং আকৃষ্ট হয়ে এসব ভেজাল ও নিষিদ্ধ ক্রিম কেনেন। অথচ তারা বুঝতেও পারেন না, এসব পণ্য ব্যবহারে তারা নিজেদের ত্বকের ক্ষতি করছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভেজাল প্রসাধনী কিনে গ্রাহকরা প্রতারিত হচ্ছেন। বিশ্বজুড়ে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই যে, কোনো ক্রিম স্থায়ীভাবে ত্বক ফর্সা করতে পারে। তবু কিছু বেনামি প্রতিষ্ঠান এসব পণ্যের অসাধু প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব ভেজাল ক্রিমে পারদসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে, যা শরীরে জমা হয়ে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। দীর্ঘদিন ব্যবহারে ত্বকের ক্যান্সার ও অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে।
রাজধানীর প্রসাধনী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ফেসবুকের পেজ ও শপিং মলে নানা বয়সী নারী ‘থানাকা ফেস প্যাক’-এর সন্ধান করছেন। মিয়ানমারের এই পণ্যটি স্থানীয় ভাষায় লেখা থাকায় অনেকের পক্ষে বোঝা কঠিন। অভিযোগ রয়েছে, বাজারে পাওয়া থানাকা নকল এবং এটি ব্যবহারে দ্রুত ত্বকের উজ্জ্বলতা পাওয়ার দাবি ভিত্তিহীন।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নামি-বেনামি ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের ব্যবহারে ত্বকের ক্যান্সারসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ধরনের প্রসাধনী ত্বকের স্বাভাবিক গঠন নষ্ট করে, লোমের বৃদ্ধি ঘটায় ও সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এটি শিশুর স্নায়ুগঠনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, যা মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলে।
চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান বলেন, ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে অনেক রোগী চিকিৎসার জন্য আসছেন। এসব প্রসাধনীতে স্টেরয়েডজাতীয় উপাদান থাকতে পারে, যা ত্বক পাতলা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে ত্বকে সংক্রমণসহ নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় এবং দীর্ঘদিন ব্যবহারে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিদেশি প্রসাধনীতে আমদানিকারকের স্টিকার নেই, ফলে আসল-নকল যাচাই করা কঠিন। বিক্রেতারা পণ্যের উৎস সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারেন না এবং কিছু সিন্ডিকেট এসব পণ্য সরবরাহ করে। অনেক পণ্য মেয়াদোত্তীর্ণ এবং বিএসটিআই অনুমোদনবিহীন। অনলাইনে বিভিন্ন পেইজে বিক্রি হওয়া এসব প্রসাধনীর মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
তদন্তে জানা গেছে, বাজারে বিএসটিআই অনুমোদনবিহীন ফেস ক্রিম, ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমসহ নানা প্রসাধনী বিক্রি হচ্ছে। নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও এসব ক্রিমে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। ঈদ সামনে রেখে ভেজাল প্রসাধনীর বিক্রি আরও বেড়েছে।
ডলার সংকটের কারণে ব্র্যান্ডেড প্রসাধনীর দাম বেড়ে যাওয়ায়, নকল প্রসাধনীর ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছেন। তারা নামিদামি ব্র্যান্ডের নামে নকল পণ্য বাজারজাত করছেন।
অনলাইনে নিষিদ্ধ ক্রিমের রমরমা বাণিজ্য : পারদসহ ক্ষতিকর উপাদান থাকার কারণে পাকিস্তান, ভারত ও চীনের ১৫ ধরনের স্কিন ক্রিম ও লোশন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিএসটিআই এসব পণ্য পরীক্ষা করে বিপজ্জনক উপাদান পাওয়ায় নিষিদ্ধ করেছে। দীর্ঘদিন ব্যবহারে ত্বকের জটিলতা তৈরি হওয়ায় এসব পণ্যের বিক্রি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, শপিং মল ও অনলাইনে এসব নিষিদ্ধ পণ্য অবাধে বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন ফেসবুক পেজে পাকিস্তানের ‘গৌরী ক্রিম’, ‘হোয়াইট পার্ল’, চীনের ‘ড. রাসেল নাইট ক্রিম’ ও ‘ড. ডেভি স্কিন লোশন’-এর প্রচারণা চলছে এবং অনায়াসে বিক্রি হচ্ছে।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান জানিয়েছেন, ভেজাল প্রসাধনীর বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। ঈদ সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের নকল পণ্য বিক্রি না করার সতর্কতা দেওয়া হয়েছে। রমজানে ৯০টি অতিরিক্ত টিম মাঠে কাজ করছে, ঢাকাতেও তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। তবু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ফাঁক গলে নকল পণ্য বিক্রি করছে। ভোক্তাদের প্রতি অনুরোধ, নিজেদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করে ক্ষতিকর প্রসাধনী ব্যবহারে সতর্ক হোন।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta