‘এমপি’ বাবুর সহায়তায় অসংখ্য অপরাধে লাক মিয়া
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের ছোট বিনাইচর গ্রামের কৃষক লাল মিয়া ও তাঁর স্ত্রীর তিনটি সন্তান ছিল, দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে। বড় ছেলে কুদরত আলী সরকারি চাকরি করেন, ছোট ছেলে আবদুল মতিন শারীরিক প্রতিবন্ধী। ১৮ শতাংশ কৃষিজমি ছিল তাঁদের একমাত্র সম্পদ, এবং সে জমি চাষ করে সংসার চালাতেন লাল মিয়া।
এক সময় ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ‘এমপি’ বাবুর সহায়তায় লাক মিয়া নামের এক গডফাদার ওই জমিতে নজর দেয়। জমি দখল করতে রাতের আঁধারে লাক মিয়ার সন্ত্রাসীরা কৃষক লাল মিয়ার পরিবারে হামলা চালায়। শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদুল মতিনকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। পরবর্তীতে জমি হারানোর দুঃখে লাল মিয়া মারা যান।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার হাজারো মানুষের স্বপ্ন ধ্বংস করে দিয়েছেন স্থানীয় সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী লাক মিয়া। ক্ষমতার অপব্যবহার, নিরীহ মানুষের জমি দখল, নদী দখল করে শিল্প স্থাপন, মাদক কারবারসহ আরও অনেক অপরাধে লাক মিয়া জড়িত। এমপি বাবুর সহায়তায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন লাক মিয়া ও তার পরিবার। লাক মিয়ার ভাতিজা নাঈম হাসান এক সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীকে অপহরণ করে ধর্ষণ করেন।
লাক মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আড়াইহাজারের সাধারণ মানুষ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন।
আড়াইহাজার উপজেলার উজান গোবিন্দ গ্রামের দিনমজুর ছাবেদ আলীর ছেলে লাক মিয়া, ছয় ভাইয়ের মধ্যে অভাব অনটনের মধ্যে বড় হয়েছিলেন। তিনি প্রথমে তাঁতের ব্যবসা শুরু করেন, কিন্তু অভিযোগ রয়েছে যে তিনি একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আড়াইহাজারের তাঁতশিল্পকে ধ্বংস করেছেন। ২০০৮ সালে এমপি নজরুল ইসলাম বাবু নির্বাচিত হওয়ার পর লাক মিয়ার সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। ২০১৩ সালে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ভোটকেন্দ্র দখল করে লাক মিয়া ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এমপি বাবুর সাহায্যে ইউনিয়নবাসীকে জিম্মি করে লাক মিয়া একটি বিশাল ক্যাডার বাহিনী তৈরি করেন।
লাক মিয়া তার স্পিনিং মিলের সম্প্রসারণের জন্য নিরীহ মানুষের জমি দখল করেন। তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। গত ১৬ বছরে লাক মিয়া স্পিনিং মিলের বেশ কয়েকটি ইউনিট বাড়িয়েছেন।
লাক মিয়া তিনবার ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, এর মধ্যে দুবার তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এমপির দাপট ও সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে প্রার্থী হতে সাহস পাননি।
আড়াইহাজার-ভুলতা আঞ্চলিক মহাসড়কের দুই পাশে লাক মিয়া তার শিল্প-কারখানা স্থাপন করেছেন, যার মধ্যে ‘ভাই ভাই স্পিনিং মিলস লিমিটেড’, ‘জামান স্পিনিং মিলস লিমিটেড’, ‘লতিফা স্পিনিং মিলস লিমিটেড’, এবং ‘সাবেদ আলী স্পিনিং মিলস লিমিটেড’ এর ১০টি ইউনিট রয়েছে। এই শিল্প-কারখানাগুলি কৃষিজমি ও ব্রহ্মপুত্র নদ দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে।
২০০৪ সালে লাক মিয়া ও তার ভাই হক মিয়া বিনাইচরে কারখানা স্থাপন শুরু করেন। কৃষক জুলহাস মিয়ার জমি দখল করার চেষ্টা করলে তাকে এবং তার পরিবারকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি জমি ছাড়তে বাধ্য হন।
লাক মিয়ার স্পিনিং মিলের পাশের জমি দখল করেছেন স্থানীয় মানুষও। রাসেল ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তি জানান, লাক মিয়া তার জমি জোর করে দখল করেছেন এবং এই অত্যাচারের কথা বর্ণনা করার ভাষা নেই।
পারভিন আক্তার নামের এক ভুক্তভোগী জানান, তিনি নিজের স্বপ্নের বাড়ি তৈরি করেছিলেন, কিন্তু লাক মিয়ার সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচারে তাকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন।
লাক মিয়া ও তার পরিবারের অপরাধে এলাকার সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। লাক মিয়ার ভাতিজা নাঈম হাসান ২০১২ সালে একটি মেধাবী ছাত্রীকে অপহরণ করে ধর্ষণ করেন, এবং এই ঘটনায় তাকে যাবজ্জীবন সাজা হয়। কিন্তু জামিনে মুক্ত হয়ে নাঈম এখনো সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।
লাক মিয়া আড়াইহাজার উপজেলায় মাদক কারবারের বিস্তার ঘটিয়েছেন, যার দেখভাল করেন সোহেল মেম্বার, যিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি।
লাক মিয়ার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের মধ্যে রয়েছে হত্যা, অস্ত্র, চেক জালিয়াতি এবং আরও অনেক মামলা। পুলিশের সুপারintendent প্রত্যুষ কুমার মজুমদার জানিয়েছেন, লাক মিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলি খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং পুলিশ কাজ করছে যাতে তিনি আইনের বাইরে যেতে না পারেন।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta