রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে কলেজছাত্রীকে যৌন হেনস্তা, গ্রেপ্তার ২
যতদিন পর্যন্ত সাংবাদিকদের উপর চাপ না বাড়বে, ততদিন পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া অসম্ভব। মানুষ ভুল করে, কিন্তু ইতিহাস ভুলে না। আমাদের রাজনীতিবিদরা যেমন সবকিছু ভুলে যান, ঠিক তেমনি আমরা সাংবাদিকরাও অনেক কিছু ভুলে যাই...
চারদিকে অস্থিরতা বিরাজ করছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সর্বত্রই অনিশ্চয়তার পরিবেশ। আমরা জানি, যেখানে ন্যায়বিচার আছে, সেখানে বিজয়ও আসে। কিন্তু দেশের ন্যায়বিচার প্রায় অনুপস্থিত। এক সময় ছিল টেলিফোন জাস্টিস, এখন মব জাস্টিস এসে ঠেকেছে। মিডিয়া এর বাইরে নয়। আমরা প্রতিনিয়ত একধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে চলছি। সেলফ সেন্সরশিপ আমাদের গ্রাস করেছে, এবং এটি মিডিয়ার প্রাকৃতিক গতি থামিয়ে দিচ্ছে। তাই মিডিয়া এখন এক ধরনের নিরবতা বজায় রাখছে, মাঝে মাঝে কণ্ঠ খুলতে চেষ্টা করছে। কখনো কখনো উদ্দেশ্যবিহীনভাবে গতি রোধ করা হয়। সেলফ সেন্সরশিপ এখন এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আজকাল আমরা নিজেই সিদ্ধান্ত নিই, কাউকে কিছু না বলে। খোলাখুলি কথা বলা কঠিন হয়ে উঠেছে, আর লেখাও হয়ে পড়েছে ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটে, অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে নয়। কেউ প্রতিবাদ করে না, সবার মুখ বন্ধ। প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে কেউ প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে না, কেউ বলে না- আমার সাথে অবিচার হয়েছে। দায়িত্বশীল সংগঠনগুলোও নিশ্চুপ। এক সময় এমন প্রতিষ্ঠান ছিল, কিন্তু এখন তা ভুলে গেছে মানুষ, বিশেষত মিডিয়াকর্মীরা। অনেক সাংবাদিক আজ চাকরি হারিয়ে নিঃস্ব। কাউকে অভিযোগ জানানোরও সুযোগ নেই। মাঝে মাঝে কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিবাদ জানালেও তা একেবারেই অপ্রতুল। আগে আমরা নিজের লাভের জন্য কাজ করতাম, এক ধরনের প্রতিযোগিতায় জড়িয়েছিলাম। কিন্তু এখন এক অজানা ভয় আমাদের পিছনে ঠেলে দিচ্ছে। টকশোতেও আজকাল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাস নিয়ে নতুন ধরনের আলোচনা শোনা যাচ্ছে। দলীয় কর্মীরা যেভাবে দৌড়াচ্ছে, তেমনি মিডিয়াকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ জেলে, আর কেউ বিদেশে পালিয়েছে। এর মধ্যে কিছু ব্যাংক হিসাবের চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে, যা জনসাধারণের মধ্যে বিরক্তি তৈরি করেছে। মিডিয়ার প্রতি মানুষের মনোভাব এখন পরিবর্তিত হয়েছে। বিভাজন এবং এক অজানা আতঙ্ক এখন গোটা মিডিয়াকে গ্রাস করেছে। প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক, সবখানে একই অবস্থা। এই পরিস্থিতি হঠাৎ তৈরি হয়নি, দীর্ঘদিন ধরে এর সাথে আমরা বসবাস করছি। স্বাধীনতার পরেও আমরা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম। সামরিক শাসনে ছিলাম নীরব, তারপর এল নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র, যেখানে ছিল নিয়ন্ত্রণ। হাসিনার শাসনে মিডিয়া নিজেদের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছিল। জনগণের সামনে আমরা নিজেদের আত্মপরিচয় বিলুপ্ত করেছিলাম, যদিও তা জনসাধারণের জন্য লজ্জাজনক হলেও আমরা সে বিষয়ে কিছু করিনি। এখন সেই কারণে মিডিয়া প্রায় অস্তিত্ব সংকটে। এখন আর কেউ সত্য খবরের পেছনে দৌঁড়ায় না, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিদায় নিচ্ছে। অনেকেই এর পেছনে উদ্দেশ্য খুঁজে পায়, এবং এমনকি ‘ট্যাগ’ লাগিয়ে দেয়। এর ফলে সংবাদ সংগ্রহের পেছনে কেউ সাহসী হয়ে উঠছে না। মিডিয়া হাউসগুলো সময়ের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে, যদিও তা অযৌক্তিক। ডিজিটাল এবং সাইবারসহ বিভিন্ন আইনি এবং বেআইনি বাধাগুলো মিডিয়ার গতি রোধ করছে। তাহলে কি এই পরিস্থিতি পাল্টানো সম্ভব? কিছু মানুষ বলেন, এটি অবশ্যই সম্ভব। রাজনীতিবিদরা যদি শুভ বুদ্ধি প্রর্দশিত করেন, তবে রাতারাতি পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। তবে আমার মনে হয়, সাংবাদিকদের বিবেকের ওপর চাপ না বাড়ালে, পরিস্থিতি কখনোই পরিবর্তিত হবে না। মানুষ ভুল করে, কিন্তু ইতিহাস ভুলে না। আমাদের রাজনীতিবিদরা যেমন সব কিছু ভুলে যান, তেমনি আমরাও ভুলে যাই। ৫৩ বছরের সাংবাদিকতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমনটাই দেখা যায়। স্বাধীন দেশের সাংবাদিকতায় বরাবরই এমন অবস্থা বিরাজ করছে। এজন্য আমি রাজনীতিবিদদের এককভাবে দায়ী করি না। অধিকাংশ সময়, আমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনেছি। অন্যের কণ্ঠরোধের খবরেও আমরা হাততালি দিয়েছি, বিশেষ বিশেষ জায়গায় গিয়ে বলেছি, যা হয়েছে তা ঠিকই হয়েছে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, মানবজমিন
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta