বাংলাদেশ এবং আমেরিকার পারস্পরিক শুল্ক
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসা মানে যেন পৃথিবীজুড়ে হইচই শুরু হওয়া। তাঁর কিছু সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী এবং নিজ দেশের ভিতরেও ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। তবে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কাণ্ডারি ট্রাম্পের এ ব্যাপারে কোনো অনুশোচনা নেই। তাঁর আগ্রাসী মনোভাবের আভাস আগের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে পাওয়া গিয়েছিল।
এখন তাঁর আগ্রাসী মনোভাব আরও প্রবল হয়েছে। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হিসেবে তিনি আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন—যা ১০ থেকে ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই পদক্ষেপই বর্তমানে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। প্রথমে যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ডলারের বিপরীতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনা ঘোষণার পর, বিশ্ববাজারে সোনার দাম বেড়ে গেছে। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি আউন্স সোনার দাম তিন হাজার ১২৯.৪৬ ডলারে পৌঁছেছে (বাংলাদেশি মুদ্রায় তিন লাখ ৭৬ হাজার ৮৯৯.৩৩ টাকা), যা আগের থেকে ০.৬ শতাংশ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে সোনা ব্যবসায়ী তাই উওং বলেন, ‘এই নতুন শুল্ক পরিকল্পনা আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি আগ্রাসী। এটা কার্যকর হলে বাজারে সোনার বিক্রি বাড়বে এবং ডলারের মান কমবে।’
দুই
একটি দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করার ফলে তার অর্থনীতিতে কিভাবে প্রভাব পড়ে, তা অর্থনীতিতে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত। প্রথমত, শুল্ক বাড়ানোর ফলে রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশসহ অনেক দেশ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে শুল্ক বাড়ায়। দ্বিতীয়ত, শুল্ক দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা প্রদান করে। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ‘শিশু শিল্প’ গড়ে ওঠে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। তৃতীয়ত, শুল্ক আরোপের ফলে ভোক্তার উদ্বৃত্ত কমে, অন্যদিকে দেশীয় উৎপাদকের উদ্বৃত্ত বৃদ্ধি পায়। তবে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, মুক্ত বাণিজ্য বা অবাধ বাণিজ্যের ফলে উভয় দেশের কল্যাণ বেড়ে যায়।
তিন
তবে ট্রাম্পের দাবি, যেসব দেশ তিনি শুল্ক বাড়িয়েছেন, সেসব দেশ আমেরিকায় পণ্য রপ্তানি করে বেশি, কিন্তু আমেরিকা সেসব দেশের পণ্য কিনে খুব কম। এর ফলে আমেরিকায় বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, যা বহু বছর ধরে চলতে আসছে। এই বৈষম্য শেষ করতে ট্রাম্প শুল্ক বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছেন।
চার
ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ বা পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন। আগে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক ছিল, তবে এখন তা ৩৭ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০.৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ থেকে ২.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং বাংলাদেশে রপ্তানি হয়েছে প্রায় সাড়ে আট বিলিয়ন ডলারের পণ্য।
এছাড়া ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ব্যবস্থা শুধু বাংলাদেশকেই নয়, অন্যান্য এশীয় দেশগুলোকে থেকেও ব্যাপক প্রভাবিত করছে। শুল্কের হার বৃদ্ধি পেয়ে চীন, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ আরও কয়েকটি দেশ এর আওতায় পড়েছে।
পাঁচ
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক ব্যবস্থার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি ন্যায্য প্রতিযোগিতা শুরু হবে, তবে মার্কিন ভোক্তাদের শুল্ক বৃদ্ধি থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে, তা গুরুত্বপূর্ণ।
ছয়
বিশ্ববাজারে ট্রাম্পের শুল্ক পাল্টানোর ফলে বাণিজ্যযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। মার্কিন শেয়ারবাজার, সোনার দাম এবং ডলারের মানের ওপর ইতিমধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
এছাড়া, বাংলাদেশের জন্য শুল্ক হার কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এতে বাংলাদেশের পণ্য মার্কিন বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে, যা বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে।
সাত
‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আওতায় পাল্টা শুল্ক আরোপের মাধ্যমে ট্রাম্প হয়তো কিছু সময়ের জন্য সুখী হতে পারেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি বিশ্বের জন্য কল্যাণকর নয়। পৃথিবীর সব দেশের উচিত হবে শুল্ক কাঠামোকে যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta