মসজিদগুলোতে সামাজিক সহায়তা বৃদ্ধি প্রয়োজন
রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর সর্বপ্রথম কাজ হিসেবে মসজিদে নববী নির্মাণ করেন। এই উদ্যোগ থেকে স্পষ্ট হয়, ইসলামী সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে মসজিদের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধু নামাজ পড়ার স্থান নয়, বরং একটি সমাজের প্রাণ ও চেতনার কেন্দ্র।
এই প্রবন্ধে মসজিদের বহুমাত্রিক সামাজিক প্রভাব এবং সমাজ গঠনে তার অবদান নিয়ে আলোচনা করা হবে।
১. সামাজিক সংহতি ও সহায়তার কেন্দ্রবিন্দু
মুসলমানরা দিনে পাঁচবার একসঙ্গে নামাজ পড়ে, যা তাদের মধ্যে আত্মিক বন্ধন গড়ে তোলে। কোনো সদস্য যখন কষ্টে পড়ে, তখন মসজিদের ভাইরা তার পাশে দাঁড়ায়। হাদিসে এসেছে, ‘মুমিনগণ একে অপরের প্রতি এমন যেন একটি দেহের অঙ্গ; যখন একটি অঙ্গ ব্যথিত হয়, সমগ্র দেহ অসুস্থ হয়।’
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৬)
২. পরিচয় ও ভ্রাতৃত্ব গড়ার স্থান
মসজিদে নিয়মিত মিলিত হয়ে এলাকার মানুষ একে অপরকে চিনে নেয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব এবং বন্ধুত্ব থেকে ঈমানভিত্তিক ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পরের ভাই।’
(সুরা হুজুরাত, আয়াত ১০)
এই ভ্রাতৃত্ব সমাজে সহিষ্ণুতা ও ঐক্য সৃষ্টি করে।
৩. সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনক্ষেত্র
মসজিদে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, যুবারা-বৃদ্ধ সবাই সমানভাবে অংশ নেয়। এখানে বর্ণ, জাতি বা সামাজিক অবস্থানের পার্থক্য হারিয়ে যায়। এটা সাম্যবোধের একটি সুস্পষ্ট প্রতীক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই অনারবের ওপর, শুধুমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠতা নির্ধারিত হয়।’ (বায়হাকি, হাদিস : ৫১৩৭)
৪. বিপদে সহানুভূতির আশ্রয়
যখন কেউ অসুস্থ, দুঃখে বা শোকাহত হয়, মসজিদের মুসল্লিরা তার পাশে থাকে। অসুস্থের খোঁজখবর নেয়া, দূরে থাকা মানুষের পরিবারের খবর রাখা—এসব মসজিদের একটি সুসংগঠিত সামাজিক ব্যবস্থার অংশ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুমিনরা যেন একটি দেহ, যার এক অঙ্গ অসুস্থ হলে পুরো দেহ অসুস্থ হয়।’
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৬)
৫. একাকিত্ব দূর করা ও বৃহত্তর পরিবার
যারা একা, পরিবারহীন বা বিচ্ছিন্ন তারা মসজিদে এসে সামাজিক নিরাপত্তা অনুভব করে। মসজিদের সদস্যরা তাদের খোঁজ নেয়, আলাপ করে এবং ভালোবাসা দিয়ে গ্রহণ করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একজন যুবক মসজিদে ঝাড়ু দিত। সে মারা গেলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার জানাজার নামাজ আদায় করেন এবং কবর আলোকিত করার জন্য দোয়া করেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯৫৬)
৬. সমাজে করুণা ও স্নেহের প্রসার
মসজিদ এমন এক স্থান যেখানে সবাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একত্রিত হয়। এখানে দুনিয়ার প্রতিযোগিতা নয়, বরং অন্তরের করুণা ও সহানুভূতির বিকাশ হয়, যা সমাজে শান্তি বজায় রাখে।
৭. জুমার মাধ্যমে বৃহত্তর ঐক্য
জুমার নামাজে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসল্লিরা মসজিদে একত্র হয়। খতিব ইসলামী ভ্রাতৃত্ব, সামাজিক দায়িত্ব ও ঐক্যের গুরুত্ব তুলে ধরেন। ফলে একে ধর্মীয় অনুশীলন ছাড়াও সামাজিক পুনর্মিলন ও মানসিক পুনর্গঠনের সময় হিসেবে দেখা হয়।
৮. বিচ্ছিন্ন সমাজে একতার পুনরুদ্ধার
আধুনিক জীবনে পরিবারে বিচ্ছিন্নতা ও অবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মসজিদ এক বিকল্প সামাজিক কাঠামো হিসেবে কাজ করে, যেখানে মানুষ একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল ও আন্তরিক হয়। এর ফলে সমাজে ইসলামিক মূল্যবোধ ফিরে আসে।
৯. ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু
মসজিদে শুধু নামাজই হয় না, বরং ইসলামী শিক্ষা, হাদিস, তাফসির, ফিকহ ও আখলাক শেখানো হয়। এটি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের নৈতিক উন্নয়নে সহায়ক।
১০. নেতৃত্ব ও সমাজ সংস্কারের কেন্দ্র
ইতিহাসে দেখা যায়, মসজিদই ছিল সমাজ সংস্কার, দাওয়াতি কার্যক্রম এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্র। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবারা মসজিদেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন। এটি নেতৃত্ব গঠনের গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
মসজিদ কেবল একটি ভবন নয়; এটি ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র। মসজিদ আমাদের আত্মিক শক্তি, ভ্রাতৃত্ব ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের উৎস। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত মসজিদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা ও সমাজে তার গুরুত্ব বাড়ানো।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে মসজিদের সঠিক মর্যাদা বুঝে তা রক্ষা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
(আল-ইমাম.ডটকম অবলম্বনে)
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta