বিরোধ, ক্ষোভ ও বিক্ষোভ
কলকাতা, চেন্নাই এবং আহমেদাবাদে বড় ধরনের প্রতিবাদ
বিল পাস হলে মুসলিমদের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হবে
বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমালোচনা
মমতার ঘোষণা: অ-বিজেপি সরকার হলে বিল বাতিল হবে
ভারতে মুসলিমদের দান করা বিশাল পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনের জন্য একটি বিল সম্প্রতি লোকসভায় পাস হয়েছে। গত বুধবার রাতে ১২ ঘণ্টার দীর্ঘ আলোচনা শেষে এই ওয়াকফ (সংশোধনী) বিলটি পাস হয়। বিজেপি সরকারের দাবি, এই বিলটি আইনে পরিণত হলে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আসবে। কিন্তু বিরোধী দল এবং অধিকাংশ মুসলিম সংগঠন মনে করছে, এই বিলটি মুসলিমদের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করবে।
বিলটি ২৮৮-২৩২ ভোটে লোকসভায় পাস হয়। এখন এটি রাজ্যসভায় যাবে। সেখানে পাস হলে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে পাঠানো হবে এবং তার স্বাক্ষরের পর এটি আইনে পরিণত হবে। এই বিলের পাস হওয়ার পর বাংলাদেশেও প্রতিবাদ দেখা গেছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এই বিলের সমালোচনা করে অবিলম্বে বাতিল করার দাবি জানিয়েছে।
অন্যদিকে, গত শুক্রবার কলকাতা, চেন্নাই এবং আহমেদাবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। জুমার নামাজের পর হাজার হাজার মুসলিম রাস্তায় নেমে আসেন এবং 'ওয়াকফ সংশোধনী বিল বাতিল' স্লোগান দেন। পশ্চিমবঙ্গের আগামী নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এই বিক্ষোভ পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তিনি রাজ্যের মুসলিমদের জমি হারাতে দেবেন না। তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে দেশ বিভক্ত করার চেষ্টা করার অভিযোগ এনে বলেছেন, যদি নতুন অ-বিজেপি সরকার গঠন হয়, তবে এই বিল বাতিল করা হবে।
ওয়াকফ কী: ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, মুসলমানরা নিজেদের সম্পত্তি সমাজের কল্যাণে দান করে, যা ওয়াকফ নামে পরিচিত। এসব সম্পত্তি আল্লাহর জন্য নির্ধারিত, তাই তা বিক্রি বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায় না। ওয়াকফ সম্পত্তি সাধারণত মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান এবং এতিমখানা নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। তবে, অনেক সম্পত্তি এখন খালি পড়ে আছে বা অবৈধ দখলে রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে ওয়াকফ ঐতিহ্য ১২শ শতাব্দী থেকে শুরু। বর্তমানে ওয়াকফ অ্যাক্ট, ১৯৯৫ এর অধীনে এসব সম্পত্তি নিয়ন্ত্রিত হয়। সরকারের তথ্য মতে, ভারতে প্রায় ৮৭২,৩৫১টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি রুপি।
বিলের বিতর্ক: মুসলিম সম্প্রদায় এই বিলের কিছু প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন। সবচেয়ে বিতর্কিত প্রস্তাবটি হলো ওয়াকফ সম্পত্তির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরিবর্তন, যা অনেক ঐতিহাসিক মসজিদ, দরগাহ এবং কবরস্থানের ওপর প্রভাব ফেলবে। বহু বছর ধরে এসব সম্পত্তি মুসলিমদের ব্যবহারাধীন, কিন্তু তাদের অনেকেরই নথিপত্র নেই। ১৯৫৪ সালের ওয়াকফ আইনে এসব সম্পত্তি 'ব্যবহারকারীর ওয়াকফ' হিসেবে গণ্য হতো, কিন্তু সংশোধনীতে এই বিধানটি বাতিল করার কথা বলা হয়েছে, যার ফলে এসব সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।
ওয়াকফ আইন সংশোধনের বিরোধিতা: ভারতে মুসলিমদের দান করা ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় সংশোধনীর প্রস্তাব মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। ভারত সরকারের দাবি, তারা ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি দূর করতে এবং আইনটি সংস্করণ করতে চায়। তবে বিরোধী দল এবং মুসলিম সংগঠনগুলো এই সংশোধনীগুলিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যা সংখ্যালঘুদের অধিকার ক্ষুণ্ন করবে বলে তারা দাবি করছে।
বিক্রির অধিকার হারানোর আশঙ্কা: ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন বিল মুসলমানদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিলটি ওয়াকফ বোর্ডের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে অমুসলিমদের সদস্য অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব দিয়েছে। মুসলিমদের দাবি, এই সংশোধনী ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা কমিয়ে দেবে।
বিল পাস হওয়ার পর কলকাতা, চেন্নাই এবং আহমেদাবাদে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে। হাজার হাজার মুসলিম রাস্তায় নেমে 'ওয়াকফ সংশোধনী বিল প্রত্যাখ্যান' স্লোগান দেয়। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের আগেই এই প্রতিবাদ পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে, চেন্নাইতে অভিনেতা বিজয়ের নেতৃত্বে রাজ্যব্যাপী বিক্ষোভ হয়। তিনি এই বিলকে 'গণতন্ত্রবিরোধী' আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা: পশ্চিমবঙ্গে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতোমধ্যে বলেছেন, রাজ্যের মুসলিমদের জমি হারাতে দেবেন না এবং বিজেপিকে দেশ বিভক্ত করার চেষ্টা করার অভিযোগ করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, একটি অ-বিজেপি সরকার গঠন হলে এই বিল বাতিল করা হবে।
বিল পাসের ফল: বিতর্কিত ওয়াকফ বিলটি ২৮৮-২৩২ ভোটে পাস হয়েছে। এখন এটি রাজ্যসভায় যাবে এবং রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি আইনে পরিণত হবে।
বিলের পরিবর্তন: সংশোধনীর মূল বিষয় হলো রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড এবং কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে অমুসলিম সদস্য অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া দানকারীদের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতার সনদ প্রদান করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ওয়াকফ সম্পত্তির তর্ক: ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলিমদের জন্য ধর্মীয় ও সামাজিক কল্যাণে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিলটি মুসলমানদের মৌলিক অধিকার ও সংবিধান বিরোধী বলে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং জামায়াতে ইসলামী এই বিলের বিরোধিতা করে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছে।
এছাড়া, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলি এই বিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন বিবৃতি দিয়েছে, বিশেষত মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার এবং সম্পত্তির ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta