এনবিআর চেয়ারম্যান: রেমিট্যান্সের মাধ্যমে ৭৩০ কোটি টাকা দেশে নিয়ে এসেছেন এক ব্যক্তি
ব্রিটেনের প্রভাবশালী সংবাদপত্র ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর সাংবাদিক হান্না এলিস-পিটারসেন সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন। তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সফর শেষে তিনি দ্য গার্ডিয়ানে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, যা দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে। প্রতিবেদনটির একটি অংশে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ঢাকার সড়ক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর মনে হয়েছে, বাংলাদেশ এখন এক গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি।’
এই সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনায় হান্না এলিস-পিটারসেনের উক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। অনেক রাজনৈতিক নেতা তার কথাগুলো উদ্ধৃত করে সরকারের কাছে বাংলাদেশে চলমান সংকট মোকাবিলার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। তবে বাস্তবতা কী? বাংলাদেশ কি আসলেই খাদের কিনারে রয়েছে, নাকি হান্নার মন্তব্য কিছুটা অতিরঞ্জিত?
এটা সত্যি যে, ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর নতুন সরকার খুব একটা স্বস্তিতে নেই। তাদের মধুচন্দ্রিমার সময় শেষ হয়ে গেছে। এখন প্রতিদিন মানুষের প্রত্যাশা বাড়ছে, তবে সেগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশাও বাড়ছে। ৫ আগস্টের পর জনগণ নতুন সরকারের কাছ থেকে এক বিশাল পরিবর্তন প্রত্যাশা করেছিল। ১৫ বছরের স্তব্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তারা দ্রুত বঞ্চনার অবসান চায়। তাই মানুষের দাবি-দাওয়ার চাপ বেড়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দীর্ঘদিনের অভাব-অভিযোগ এবং নিপীড়নের প্রতিকার দ্রুত চাওয়া হচ্ছে। সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল, বিভিন্ন দাবিতে রাজপথ অবরোধ এবং সড়ক দখল। এর ফলে জনজীবন খুবই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সড়ক অবরোধের কারণে মানুষের কর্মজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পুলিশ বাহিনী দলীয়করণের কারণে কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল। অনেক পুলিশ সদস্য গণ অভ্যুত্থানের পর পালিয়ে গিয়েছিল, ফলে পুলিশ প্রশাসন কার্যত ভেঙে পড়েছিল। নতুন সরকার তাদের পুনর্গঠন করেছে, কিন্তু এই প্রক্রিয়া এখনও চলমান। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোবল অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে, যার প্রভাব পুলিশের কার্যক্রমে স্পষ্ট। ৫ আগস্টের পর পুলিশ বাহিনীর উদ্যম কমে গেছে। তারা পরিস্থিতি থেকে দূরে সরে গিয়ে কার্যক্রমে শিথিলতা দেখাচ্ছে, যা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও নাজুক করেছে।
আমরা জানি, ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন থানায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র লুট হয়েছিল। এসব অস্ত্র এখন সন্ত্রাসীদের হাতে। অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানও ফলপ্রসূ হয়নি। সন্ত্রাসীরা আবার তাদের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এর ফলে দেশে চুরি, ছিনতাই এবং অন্যান্য অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং মব জাস্টিসের নামে সহিংসতা দেশে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুর্বৃত্তরা প্রতিপক্ষের জমি, বাজার, হাট-বাজার দখল করে নিচ্ছে এবং এর ফলে হানাহানি ও খুনোখুনি চলছে। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাও বেড়েছে, বিশেষ করে মাগুড়ার ঘটনা সারা দেশে শোকের সৃষ্টি করেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কারণে কিছুটা আশা রয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দীর্ঘস্থায়ী অবনতি মানুষের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
এই ধরনের একটি নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতিতেও স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নন। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অর্থ মন্ত্রণালয়ের জন্য একজন বিশেষ সহকারী নিয়োগ করেছেন। ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, যিনি তার দক্ষতার জন্য পরিচিত। তিনি একটি মতবিনিময় সভায় বলেছেন, ‘কোন ব্যবসায়ী এই সরকারের অধীনে ব্যবসা করতে চাইবে? সরকার কতদিন টিকবে সেটা কেউ জানে না। সরকারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যও পরিষ্কার নয়। তাই বিদেশি বিনিয়োগ কমছে এবং দেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নন।’
৫ আগস্টের পর অনেক শিল্প কারখানা আক্রান্ত হয়েছে, সেগুলোর অনেকটিই বন্ধ হয়ে গেছে। লাখ লাখ শ্রমিক এখন বেকার। বেতন-ভাতার দাবিতে সড়ক অবরোধ চলছে। সাধারণভাবে, বাংলাদেশ এখন একটি সংকটকালীন সময় পার করছে। দেশের সার্বিক অবস্থা এখন ভালো নয়।
যদি আমরা পৃথিবীর যে কোনো দেশের বিপ্লবের পরবর্তী পরিস্থিতি দেখি, তবে বুঝতে পারব যে এমন পরিস্থিতি বিপ্লবের অঙ্গ। বিশেষ করে বিপ্লবের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নতুন সভ্যতার সূচনা হয়। বাংলাদেশ এখন সেই ধ্বংসের পর নতুন সৃষ্টির পথে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে যে দুর্বল প্রশাসন ও আইনি কাঠামো ছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক সময় লাগবে। ৫ আগস্টের পর, বাংলাদেশ সেই কঠিন সময় পার করেছে। এই কারণেই হয়তো হান্না এলিস-পিটারসেন ঢাকার সড়ক দিয়ে হাঁটার সময় বাংলাদেশকে খাদের কিনারে দেখতে পেয়েছেন। তবে বাংলাদেশের মানুষের মনোবল এবং ইতিহাস প্রমাণ করে, এই অস্থিরতা এবং হতাশা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
বাংলাদেশের মানুষ কখনো হারে না, তারা সবসময় নতুন স্বপ্নে বিশ্বাস রাখে। তাদের মধ্যে রয়েছে অফুরন্ত শক্তি এবং সাহস। বিপদ বা দুর্যোগ যে কোনো পরিস্থিতিতেই তারা ঘুরে দাঁড়ায়। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য।
মার্চ মাস আমাদের স্বাধীনতার মাস। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ, হত্যাযজ্ঞ এবং অপারেশন সার্চলাইটের পরেও বাংলাদেশ হারেনি। তখনও দেশ খাদের কিনারে চলে গিয়েছিল, কিন্তু দেশের জনগণ অভূতপূর্ব সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ মুক্ত করেছে। আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। বাংলাদেশের জনগণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা রাজনৈতিক দুর্যোগ যাই হোক না কেন, তারা লড়াই করে, ঘুরে দাঁড়ায়, এবং কখনো হার মানে না।
আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। বিশ্বের অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, বাংলাদেশ কখনো দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা থেকে মুক্তি পাবে না, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ প্রমাণ করেছে যে তারা দারিদ্র্য ও ক্ষুধা মোকাবিলা করতে পারে। দেশের জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ বাংলাদেশ এখন উন্নতির পথে।
বাংলাদেশের ইতিহাস এভাবেই পরিবর্তিত হয়েছে। বিপ্লবের পর থেকে দেশটি প্রতিটি বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে এবং নতুন এক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে গেছে। দেশের জনগণ কোনো পরিস্থিতিতেই পরাজয় মেনে নেয় না।
লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল : [email protected]
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta