সমষ্টিগত মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রত্যাশা
দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকালে জনগণের কাছে গেলেও তারা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ নয়। বরং তারা ক্ষমতা, অস্ত্র, কালো টাকা এবং সন্ত্রাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে...
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অনেক ঘটনার সাক্ষী। ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব, স্বাধীনতা আন্দোলন সবকিছুই প্রত্যক্ষ করেছি। এরপর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়। যুক্তফ্রন্টের বিজয় এবং সামরিক শাসনের পর মানুষ বিক্ষোভ শুরু করে। ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ঘটে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পায়। রাষ্ট্রীয় স্তরে পরিবর্তন আনতে গেলে সমাজে পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, তবে সে পরিবর্তন হয়নি। যদিও সামাজিক পরিবর্তনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ছিল ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্র, পাকিস্তান রাষ্ট্র। এমনকি স্বাধীনতার পর যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা সমাজ-বিপ্লবের পক্ষে কাজ করেনি। এ রাষ্ট্র একইভাবে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদী, আর শাসন ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র বিরাজমান। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের জন্য জনগণের কাছে গেলেও তারা জনগণের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং ক্ষমতা, অস্ত্র, কালো টাকা ও সন্ত্রাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভর করে, এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সরকার ও বিরোধী দল সাম্রাজ্যবাদের কৃপা লাভের জন্য সচেষ্ট। এসব বুর্জোয়া দলের বিপরীতে জনগণ কোনো ভালো বিকল্প না পেয়ে, পরপর ভোট দিয়ে আসে। কিন্তু জনগণের ভাগ্য তেমন পরিবর্তিত হয়নি। বর্তমানে, জনমতের প্রতি উপেক্ষা করে, এই দুই দল সাম্প্রদায়িক দলগুলোর সাথে জোট বেঁধেছে, ফলে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নষ্ট হয়ে গেছে। অতীতে ইরাকের মার্কিন আগ্রাসন এবং সাম্প্রতিক ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেশে বৃহত্তর আকারে হয়নি। বামপন্থি এবং মৌলবাদীরা কিছু প্রতিবাদ করলেও বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো এর অংশ হয়নি। এ থেকে বোঝা যায়, তারা কতটা সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল। সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপস করে ক্ষমতায় থাকে শাসক দল। স্বাধীন এই রাষ্ট্রের বিকেন্দ্রীকরণ কেবল প্রয়োজনীয় ছিল না, বরং অত্যন্ত জরুরি ছিল। ক্ষমতা শুধু রাজধানী থেকে কেন্দ্রীভূত না রেখে, স্থানীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল। নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে। এমন একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলা দরকার, যেখানে সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপস করা হবে না, সন্ত্রাসের কোনো স্থান থাকবে না এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন বা নিরাপত্তাহীনতা থাকবে না।
অধিকার ও মুক্তি অর্জনের জন্য একটি বিকল্প পথ দরকার, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পূর্ণ হয়েছে, কিন্তু সে লক্ষ্য এখনো অধরা। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে একটি দেশ গড়া, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদমুক্ত সমাজ থাকবে। এক্ষেত্রে, রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হবে। বাম দলগুলোর জন্য এ সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে তাদেরকে অবশ্যই ক্ষমতার লোভ ত্যাগ করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার মূল কারণ ছিল প্রধান দলগুলোর ব্যর্থতা এবং দুর্বলতা। যারা নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে না, তারা দেশ পরিচালনা করবে কীভাবে? রাজনৈতিক আদর্শে অবক্ষয় ঘটেছে, স্বার্থবাদের প্রবণতা বেড়েছে। ছাত্র রাজনীতি এখন ক্ষমতা এবং অর্থের লোভে চলে গেছে, অথচ অতীতে ছাত্ররা জনগণের সেবা করতে রাজনীতি করত। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার এসেছে, কিন্তু এতে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। বরং দলীয় রাজনীতির কারণে নৈরাজ্য এবং লুণ্ঠন বেড়ে গেছে।
দেশের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেছে। খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং নিপীড়ন বেড়েছে। দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের হার বেড়েছে, বিরোধী নেতাদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। বিরোধী দলকে দেশ থেকে মুছে ফেলার জন্য শাসক দল নিরন্তর চেষ্টা করছে। আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে, ব্যাংক থেকে জনগণের সঞ্চিত অর্থ লুট হয়ে গেছে, রিজার্ভ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আমদানি নির্ভর দ্রব্যের মূল্য হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণে জনগণ ভোগান্তিতে পড়েছে। দুর্নীতি আর্থিক খাতে প্রবল হয়েছে, যা দেশে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ এখন মানব বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়েছে। দেশীয় বুর্জোয়া দলগুলো প্রকৃত জাতীয়তাবাদী নয়, তারা জনগণের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে না। রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র পরিবর্তন ঘটাতে তারা কিছুই করেনি। দেশপ্রেমিকরা যাতে সামাজিক পরিবর্তন আনতে পারে, তাদের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। ক্ষমতার লাভের সুযোগে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা একচেটিয়াভাবে লুণ্ঠন করছে, আর এর খেসারত দিচ্ছে দুর্বল জনগণ।
বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্র নয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তারও অস্তিত্ব রয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সবার অংশগ্রহণে সমাজে পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজ পরিবর্তনে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ এবং সমবয়সীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সময় এখনই এসেছে।
রাষ্ট্র ও রাজনীতির মাধ্যমেই সমাজ বদলাতে হবে। রাজনীতিকদের দুর্বলতা ও ব্যর্থতার কারণে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসে, সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে, সেনাবাহিনী কোনো রাজনৈতিক দল নয়, তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য প্রস্তুত নয়। জাতীয় উন্নয়নের জন্য সরকারকে ভাবনা করতে হবে, জনগণের চাহিদার সাথে সংগতি রেখে রাজনীতি করতে হবে। অথচ দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো তা করছে না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো চিহ্নিত করে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। সরকারী হাসপাতালগুলোর অভাব, শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের অভাব এবং খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনগণের মধ্যে অশান্তি বিরাজ করছে। জনগণের জীবিকার নিশ্চয়তা নেই। অতীতে চালু ছিল আধুনিকতার ধারণা, যা পাশ্চাত্যকরণের সাথে জড়িত ছিল। এখন আধুনিকতা মানে আমেরিকান বা ইউরোপীয় চিন্তাধারা নয়, বরং এখন প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, মাতৃভাষার চর্চা এবং নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিকশিত করা। সংস্কৃতি চর্চা ও মাতৃভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করা এখন সময়ের দাবি। আমরা সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী বিশ্ব চাই না, বরং এমন একটি গণতান্ত্রিক বিশ্ব চাই যেখানে সমঅধিকার এবং সহমর্মিতা থাকবে।
সাম্রাজ্যবাদ আমাদের সংস্কৃতি শোষণ করতে চায়। তারা আধিপত্য বিস্তার করে, আমাদের সংস্কৃতি ও জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা করে। বিশ্বে এখন দুইটা শিবির তৈরি হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। যারা উদারনীতির কথা বলেছেন, তারা আজ বুঝতে পারছেন সাম্রাজ্যবাদ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে। আমাদের দেশী প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন তেল ও গ্যাস, এখন সাম্রাজ্যবাদীদের চোখে পড়েছে। তারা তা দখল করার জন্য কোনো সময়ও সুযোগ নিতে পারে। বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta