মোবাইল আসক্তি কমবয়সী মেয়েদের মানসিক অবসাদ সৃষ্টি করছে: গবেষণা
আজকাল প্রশ্ন উঠছে, মানুষ কি মোবাইল বা মুঠোফোন ব্যবহার করছে, নাকি মোবাইলই মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে? এটি এমন একটি প্রশ্ন, যা প্রযুক্তিবিদ কিংবা মনোবিদদের জন্যও সহজে উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ, একসময় যেহেতু মোবাইল মানুষদের জীবনকে সহজ করার জন্য তৈরি হয়েছিল, এখন তা নিজেদের জটিলতায় পরিণত হচ্ছে।
স্মার্টফোনগুলি ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বকে আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। এখন, চাইলে, বাংলাদেশে বসে খুব সহজেই আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টি বা ফ্রান্সের মাদাম তুসোর গ্যালারিতে যাওয়া সম্ভব। যে কোনো ঘটনার খবর মুহূর্তেই পাওয়া যাচ্ছে, এবং হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা মানুষদের সাথে প্রায় বাস্তবের মতো কথা বলা যাচ্ছে। স্মার্টফোনের এমন অনেক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটছে।
অনেক সময় মানুষ ভুলে যায় কোনটা বাস্তব আর কোনটা ভার্চুয়াল। সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্টের মাধ্যমে অশান্তি সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে, অথবা একটি ইউটিউব ভিডিও প্রচারিত হয়ে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে বাস্তবে। ভার্চুয়াল এবং বাস্তবের এই গোলকধাঁধায় মানুষ মোবাইলের দ্বারা আটকে পড়েছে। যে প্রযুক্তিটি জীবন সহজ করার কথা ছিল, তা এখন অনেকের জন্য এক জটিলতায় পরিণত হয়েছে। মোবাইল আসক্তি অনেক সময় মাদকাসক্তির চেয়েও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজকাল অনেকেই ফেসবুকে পোস্ট করা ছবি ও ভিডিওর লাইক এবং কমেন্টের মাধ্যমে নিজের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করছে। কেউ আবার লাইক এবং ভিউ সংখ্যা বাড়িয়ে সেলিব্রেটি হয়ে উঠছে। কিছু মানুষ সময় কাটানোর জন্য অনবরত মোবাইল স্ক্রল করে যাচ্ছে, অথবা বিভিন্ন ফিল্টারে নিজেদের ভার্চুয়ালভাবে আকর্ষণীয় করে তুলছে। বাস্তবে পরিবর্তন আনা সম্ভব না হলেও মোবাইলের মাধ্যমে অনেক কিছু বদলানো সম্ভব। এর ফলে অনেকেই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে ভার্চুয়াল জীবনকে প্রাধান্য দিতে থাকে, যা পরবর্তীতে তাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আসলে, কারা মোবাইলের প্রতি এতটা আসক্ত হয়ে পড়ছে?
সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কম বয়সী মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি মোবাইল আসক্ত হয়ে পড়ছে, যা তাদের মধ্যে বিষাদ সৃষ্টি করছে। স্মার্টফোনের স্ক্রিন টাইম শুধু চোখের ক্ষতিই করছে না, বরং মনের ক্ষতি ঘটাচ্ছে। সুইডেনের গবেষকরা এই দাবি করেছেন।
ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে কমবয়সী মেয়েদের ওপর একটি জরিপ চালিয়েছেন। তারা বলেছেন, মোবাইলে দীর্ঘ সময় ধরে স্ক্রল করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি—এই সব কিছু একদিকে যেমন ঘুমের স্বাভাবিক চক্রকে বিঘ্নিত করছে, তেমনি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে। পড়াশোনায় মনোযোগ কমছে, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে দূরত্ব বাড়ছে, এবং তরুণীরা নিজেদের এক ভিন্ন জগতে হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগে 'ব্লু হোয়েল' গেমের কারণে অনেক তরুণ-তরুণী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল, এবং তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছিল।
চিকিৎসকরা ‘ভার্চুয়াল অ্যাডিকশন’ নামক রোগটি উল্লেখ করেছেন, যা বিষাদ এবং উদ্বেগের সাথে গভীর সম্পর্কিত। তারা বলছেন, কম বয়সী মেয়েরা শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই নয়, বরং বিভিন্ন অ্যাপভিত্তিক গেম, পর্নোগ্রাফিক ভিডিওসহ আরও নানা বিষয়ে আসক্ত হয়ে পড়ছে। একসময় এই আসক্তি ছিল শহুরে সমস্যা, কিন্তু এখন এটি শহরতলি এবং গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন পোস্ট মনের উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে, মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে, এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণও হচ্ছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো: দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, অতিরিক্ত স্মার্টফোন ও ট্যাবলেট ব্যবহার খেলাধুলার অভ্যাস কমায়, ফলে স্থূলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, মানুষ নিজেদের মধ্যে একাকিত্ব অনুভব করছে। মোবাইল ব্যবহারের ফলে, পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছে, যা মানসিক চাপ তৈরি করছে। বিশেষত, মোবাইলে যা দেখছে তা অন্য কেউ দেখতে পারছে কি না, এ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। সম্পর্কের ওঠাপড়াও গভীর বিষাদ সৃষ্টি করছে।
তাহলে, অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, মোবাইল বা প্রযুক্তি ব্যবহারে সতর্কতা অপরিহার্য। আধুনিক জীবনে প্রযুক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে, তবে এও প্রশ্ন করা উচিত, 'তবে কি প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে না?'
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta